-অরিন্দম, এই যে তোর খুঁতখুতেমি, এর মানে, তুই একদিন সাইন করবি।
-করবো। আলবাৎ করবো। আই উইল গো টু দ্য টপ... দ্য টপ... দ্য টপ...
‘নায়ক’ সিনেমায় কাঠের টেবিলে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ঠুকে অরিন্দমের এই সদর্প উচ্চারণ, পঞ্চাশ বছর পর, আজও অনেককেই উজ্জীবিত করে।
অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, মানে, উত্তমকুমার। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’, বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’।
বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের মাত্র দু’টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার। ‘নায়ক’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’।
তবে, সৌমিত্রকে ছেড়ে সত্যজিৎ উত্তমকুমারকে নিয়ে‘নায়ক’ তৈরি করলেন কেন?
সিনেমার কাহিনিটি একবার মনে করে নিই:
‘নায়ক’ ছবির প্রধান চরিত্র বাংলা চলচ্চিত্রের ম্যাটিনি আইডল অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। বিমানের টিকেট না পেয়ে রেলপথে কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছেন একটি জাতীয় পুরস্কার গ্রহণের জন্য। সেদিনের সংবাদপত্রেই তার চারিত্রিক কুৎসা প্রকাশিত হয়েছে।
এই চব্বিশ ঘন্টার যাত্রাপথে ‘আধুনিকা’ পত্রিকার সম্পাদক অদিতি সেনগুপ্ত নায়কের একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। যদিও অদিতি এইসব ম্যাটিনি আইডলদের খুব একটা পছন্দ করেন না এবং সেদিনের প্রকাশিত সংবাদ পড়ে অরিন্দমকে অপছন্দই করছিলেন।
সাতটি ফ্ল্যাশব্যাক এবং দু’টি স্বপ্নদৃশ্যের মধ্য দিয়ে নায়কের জীবন ও তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানের বিবর্তমান প্রবাহ প্রকাশিত। মনে হয়, এই রেলযাত্রার মতোই নায়কের জীবন যাত্রা, কখনো দুরন্ত, কখনো ধীর লয়ে।
১২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রটি ভারতে মুক্তি পায় ৬ মে ১৯৬৬ তে। ৬৬তেই বার্লিন আন্তর্জতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বিশেষ জুরি পুরস্কার’ পায় এবং এই উৎসবেই ‘শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র’ বিভাগে মনোনয়ন পায়। ১৯৬৭তে শ্রেষ্ঠ বাংলা কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
উত্তমকুমার এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ১৯৬৬ তে বি. এফ. জে. এ (বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোশিয়েশন অ্যাওয়ার্ড) পুরস্কার পান ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’ হিসেবে।
অবশ্য ১৯৬৮ তে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ এবং ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। প্রসঙ্গত, উত্তমকুমার-ই প্রথম অভিনেতা যাকে পুরস্কার প্রদানের মধ্য দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’ বিভাগটি শুরু হয়। তার সঙ্গে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’ হিসেবে এই পুরস্কার পান নার্গিস, ‘রাত অওর দিন’এ অভিনয়ের জন্য।
সত্যজিৎ-পুত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা সন্দীপ রায় আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, “বাবা তো উত্তমকুমারকে মাথায় রেখেই ‘নায়ক’ লেখেন। অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট। কোনও গল্প থেকে নেওয়া নয়। ওকে বাদ দিয়ে কোনও বিকল্পও ভাবেননি... ভাবা যাবে না বলেই ভাবেননি নিশ্চয়ই।”
আসলেই । রুপালি পর্দায় ২১২টিরও বেশি ছবিজুড়ে ‘নায়ক’ উত্তমকুমারের যে গ্ল্যামারাস উপস্থিতি, তাকে এখনও কোনো বাঙালি অভিনেতা অতিক্রম করতে পারেননি।
দার্জিলিঙে বসে সত্যজিৎ রায়ের নিজের মুখে ‘নায়ক’-এর স্ক্রিপ্ট শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আরেক চলচ্চিত্র নির্মাতা তপন সিংহ-র। সস্ত্রীক ঝাড়া চার ঘন্টা সেই চিত্রনাট্য তিনি শুনেছিলেন। চিত্রনাট্য শোনানোর পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন “এ ছবিতে উত্তমকে নেব ভাবছি... ঠিক হবে না?” উত্তরে তপনবাবু বলেছিলেন, “উত্তম ছাড়া এ চরিত্র হয় না।”
শুধু মাত্র বাহ্যিক স্টার-ইমেজ নয়, ‘নায়ক’ সিনেমাটি দেখলেই বুঝতে পারি চূড়ান্ত সফল একজন নায়ক, তার উজ্জ্বলতার গভীরে লুকিয়ে রেখেছিলেন ভাঙাচোরা, বিপর্যস্ত নিঃসঙ্গ এক মন। সেই অন্যদিকটির সন্ধান পেয়েছিলেন অদিতি।
সন্দীপ রায় ঐ সাক্ষাৎকারেই জানাচ্ছেন, “ছুটি পড়লেই বাবা পুরী কিংবা দার্জিলিং বেড়াতে নিয়ে যেতেন আমাদের। সেবার এক আমন্ত্রণেই আমি মা বাবা গেছি দার্জিলিং। উঠেছি ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ হোটেলে। গিয়ে শুনি উত্তমবাবুও এসেছেন ঐ হোটেলেই। তখন ‘ছোটি সি মুলাকাত’ এর সমস্যায় উত্তমবাবু জর্জরিত। (প্রসঙ্গত, ‘ছোটিসি মুলাকাত’ নামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছিলেন উত্তমকুমার। তার সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ লগ্নি করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ চলচ্চিত্রটি ফ্লপ করে।)
এক ভদ্রলোক এসে বাবাকে বললেন, উত্তমবাবু দেখা করতে চাইছেন। বাবা বললেন, ‘অবশ্যই, আসতে বলুন।’ সেই সময় দেখেছিলাম... উনি এলেন। একেবারে ভেঙে পড়া চেহারা, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত... যেন ‘নায়ক’এর বেদনাক্লীষ্ট অরিন্দম মুখোপাধ্যায়।”
মনে করি ‘নায়ক’ এর একটি স্বপ্নদৃশ্য, বিশাল এক টাকার স্তূপের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন তিনি। তারপর ঝটকা দিয়ে যখন ঘুম ভাঙলো, ট্রেনের কামরায়, আর নায়কের হাত গিয়ে পড়ল জানলার কাচে... সেখানে তার যে অভিব্যক্তি... কষ্ট... বেদনা... সব থেকেও একটি ইনসিকিওরিটি... সমস্তই অনায়াস স্পষ্ট হয়ে ওঠে নায়কের অভিব্যক্তিতে।
আর তার ভুবনভোলানো হাসি?
‘নায়ক’ এর একদম প্রায় শেষদৃশ্যের কথা মনে আছে নিশ্চই? অদিতি ওরফে শর্মিলা ঠাকুর, তার নেওয়া সাক্ষাতকারের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলছেন, আর উত্তমকুমার খুব রোমান্টিকভাবে জানতে চাইছেন, “মন থেকে লিখেবেন নাকি?” উত্তরে শর্মিলা বললেন, “মনে রেখে দেব।”
প্রকৃত নায়ক, তারকা তো সেই, যাকে ছোঁওয়া যায় না। পাশে বসে থাকলেও যে থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, পাশে থেকেও কাছে নেই। অথচ যার সঙ্গে শেয়ার করা মুহূর্তগুলো সযত্নে মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চায় সকলেই। সেই-ই তো ‘নায়ক’।...
মহানায়ক উত্তমকুমারের নায়কোচিত এই অভিনয়, কে পারতেন আর? উত্তমকুমার ছাড়া?