ওরা ১১ জন: আলোচনার আলোয়

স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’। যুদ্ধ পরবর্তী প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধকে রূপালি ফ্রেমে ধরে রাখার যে তীব্র তাড়না তারই প্রতিফলন আমরা দেখি নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের এ সিনেমাটিতে। নির্মানের দিক দিয়ে খুব আহামরি কোনো ছবি হিসেবে একে গণ্য করা না হলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ও প্রায় পূর্ণাঙ্গ একটি ছবি হিসেবে এর বিশেষ মূল্য রয়েছে তা বলা যায় নি:সন্দেহে।

প্রমা সঞ্চিতাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2016, 02:29 PM
Updated : 16 Dec 2016, 02:29 PM

‘ওরা ১১ জন’ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র হলেও এ নিয়ে খুব বেশি বিশ্লেষণ দেখা যায় না। ১৯৭২র ২১শে ফ্রেব্রুয়ারি মুক্তির পর পর তৎকালীন কিছু পত্র-পত্রিকাতে সমালোচনা বেরোলেও পরবর্তীতে এ ছবিটি নিয়ে কাজ হয়েছে যৎসামান্য। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো অনুপম হায়াতের একটি সম্পাদনা গ্রন্থ, চিন্ময় মুৎসুদ্দী’র লেখা একটি প্রবন্ধ ও ড:কাবেরী গায়েন এর একটি গবেষণাপত্র। এছাড়া দৈনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমের স্বল্প কিছু সিনেমা বিশ্লেষণ।

এ সিনেমার বিশ্লেষণগুলোকে নিয়ে যদি পুরনায় বিশ্লেষণ করা হয় তবে কিছু বিষয়ে বেশ মিল পাওয়া যাবে। প্রত্যেকেই এ ছবিকে মুক্তিযুদ্ধের একটি তথ্যচিত্র হিসেবেই উল্লেখ করেছেন তাদের লেখায়। এছাড়াও সিনেমার সম্পাদনায় অভিনবত্ব, কারিগরী নৈপুন্য ও নারীর ইতিবাচক উপস্থাপনকে গুরুত্ব দিয়েছেন আলোচকেরা। 

অনুপম হায়াৎ সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র’ বইতে ‘ওরা ১১ জন’ নিয়ে চিত্র সমালোচক আহমদ জামান চৌধুরীর একটি প্রবন্ধের উল্লেখ আছে। ‘নতুন উৎসের হাতছানি’ শিরোনামের এ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “২৫ মার্চের রাতে ধর্ষণ দৃশ্যটির ট্রিটমেন্ট ভোলা যায় না। চাষী দৃশ্যটির চিত্রায়ন করেছে এভাবে : হানাদার বাহিনী একটি ঘরে ঢুকলো। কাট। গৃহিনী ভীত সন্ত্রস্ত্র। কাট। হানাদার বাহিনীর লোলুপ দৃষ্টিতে এগিয়ে আসা। কাট। সৈনিক মাকে ধরে, মায়ের চিৎকার। কাট। প্রবল শব্দে ট্যাংক এসে পড়ে। আর সৈনিকটি ধ্বংস করলো নারীর সর্বস্ব। এক প্রতীক অর্থ সৃষ্টি করেছে মন্তাজ।”

আহমদ জামান চৌধুরীর এ উপলব্ধির সাথে শতভাগ একমত হবেন যারা ছবিটি দেখেছেন। মূলত সাদা-কালো এ ছবিতে ক্যামেরার কিছু কাজ ছিলো এক কথায় অসাধারণ। সারি বেঁধে সৈন্যদের ছুটে চলা। চোখ-বাঁধা, উলঙ্গ নারীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার দৃশ্যগুলোর উপস্থাপন ছিলো শিল্পিত। রূপক ও মন্তাজের ব্যবহার এ ছবিকে একটি যুদ্ধের ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে যথেষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সের্গেই আইজেনস্টাইন-এর যুদ্ধের সিনেমা ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ এর প্রভাব এ ছবিটির সম্পাদনা ও দৃশ্যধারণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে।

এ সিনেমার যুদ্ধের দৃশ্যগুলো বাস্তব গোলা-বারুদ ও কামান নিয়েই করা হয়েছে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের সহায়তায় পাকিস্তান বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও রসদ দিয়েই যুদ্ধের দৃশ্যধারণ করা হয়েছে। এমনকি শেষভাগে মুক্তিবাহিনীর হাতে আটক পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর অত্যাচারের দৃশ্যটিতেও সত্যিকারের দু’জন যুদ্ধবন্দীকে দেখানো হয়েছে। তবে তাদের উপর নির্য্াতনের দৃশ্যগুলো সত্যি ছিলো না বলে এক সাক্ষাতকারে জানান নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম।

চিত্র সমালোচক চিন্ময় মুৎসুদ্দী’র আলোচনায় তিনি বলেন, “এই ছবিতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু কেউই অভিনেতা না। তাই অন্যান্য দৃশ্যের অভিনয় এত উন্নতমানের না হলেও যুদ্ধের দৃশ্যগুলো যথেষ্ঠ বাস্তবানুগ হয়েছে।”

বস্তুত এ বিষয়টিই একাধারে এ ছবিটির অন্যতম শক্তি ও দুর্বলতার জায়গা! ছবির অভিনেতারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তাই যুদ্ধের ময়দানে তাদের কার্যকলাপ ও গোলাগুলি প্রতিটি বিষয়ই ছিলো বেশ বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তব। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে তাদের সংলাপ করার দুর্বলতা ও প্রয়োজন অনুপাতে আবেগ ও এক্সপ্রেশনের অভাব বেশ দৃষ্টিকটু লাগবে।

এছাড়াও প্রায় দু’ঘন্টার এ ছবির মধ্যভাগে এসে কাহিনী কিছুটা মন্থর হয়ে আসে। কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপন করেছেন পরিচালক, যা না করলেও সিনেমার কোনো ক্ষতি হতো না। সিনেমার পুরো অংশ জুড়ে ছিলো না কোনো ক্লাইমেক্স। ঘটনাপ্রবাহ নির্দেশনে প্রয়োজনীয় উত্তেজনা বা সৃষ্টিতে কিছুটা ব্যর্থই বলতে হবে পরিচালককে। অথচ গল্পের ভেতর এ উত্তেজনা বা ক্লাইমেক্স সৃষ্টির যথেষ্ট সুযোগ ছিলো।

‘ওরা ১১ জন’ নিয়ে একটি বিশেষ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন ড: কাবেরী গায়েন। তার ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নারী-নির্মাণ’ শিরোনামের এ গবেষণাপত্রে তিনি লিখেছেন, “মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মূল চরিত্রে না হলেও কেবল ধর্ষিতা নয়, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণটি যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নানা মাত্রিক ছিলো, এই চলচ্চিত্রে সে’টি এসেছে।”

মূলত সেবিকা, ধর্ষিতা ও মুক্তিযোদ্ধা- এ তিনটি রূপেই মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে তুলে ধরা হয়েছে এ সিনেমাটিতে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য ছবিতে যা বেশ বিরল।সিনেমার অন্যতম চরিত্র, মুক্তিযোদ্ধা খসরুর বোন, মেডিকেল ছাত্রী মিতা যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে। সেখানেই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিগৃহীত হতে হয় তাকে। ধর্ষণের গ্লানি বয়েও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাতেই নিয়োজিত থাকে সে।

ওই একই গ্রামে বাস করে কেয়া। খসরুর অধীনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে গোপনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয় সে। অস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেয়া যখন জানতে পারে তার নিজের বাবাই গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, তখন চোখে জল এলেও বাবাকে গুলি করে মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না সে। পাকিস্তানিদের আক্রমণ শুরু হলে পুরুষ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই মেশিনগান চালায়।

সেবিকা, যোদ্ধা- এই দুই চরিত্রের পাশাপাশি নিপীড়িতা, নিগৃহিতার চরিত্রেও নারীকে দেখিয়েছেন পরিচালক। খসরুর বাগদত্তা শীলাকে (নূতন) যেমন দেখা যায় যুদ্ধ শেষে বন্দিশিবির থেকে মুমুর্ষ অবস্থায় খসরুর কোলে লুটিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করতে। স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের ইতিহাসই যেন এক নিমেষে উঠে আসে দৃশ্যটির মাধ্যমে।

তবে নারীর প্রতিচ্ছবি নির্মানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখলেও ড: কাবেরী গায়েন এর মতে, মুক্তিযুদ্ধের কোনা ছবিতেই নারীকে পূর্ণাঙ্গ প্রোটাগনিস্ট চরিত্রে দেখানো হয় নি। তিনি বলেন,“মুক্তিযুদ্ধে নারীর যত ধরণের অংশগ্রহণ ছিলো, প্রায় সব ধরণের প্রতিনিধিত্বই এই চলচ্চিত্রে পাওয়া যায়। তবুও মূল ন্যারেটিভে নারীর ধর্ষিত ইমেজটি-ই প্রধান হয়ে ওঠে এবং তাদের জীবন নায়কদের ‘মহানুভবতা’র মুখাপে¶ী হয়ে যায়।”

এ সিনেমাটি শুরু হয় ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানটির মধ্য দিয়ে। ভারতছাড়ো আন্দোলনের সময়ে রচিত এ গানটি সিনেমার সূচনা সংগীত হিসেবে দেশভাগ পরবর্তী বাংলা অঞ্চলের এক সমন্বিত সুর হিসেবেই আমাদের কানে এসে বাজবে। এর পর বিভিন্ন সময়ে দেশাত্মবোধক গানের ব্যবহার ও যুদ্ধের রণসংগীত ‘মুক্তিযুদ্ধের’ ছবি হিসেবে এ সিনেমাকে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করেছে।

সিনেমায় আবহ সংগীত ব্যবহারে চমৎকারিত্ব ছিলো। যুদ্ধের সময়ে উচ্চ স্বরে একটি মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছে এ ছবিতে যা যুদ্ধের উত্তেজনা ও অস্থিরতাকে বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের রাজাকার বেজার আলি যখন মুক্তিবাহিনীর খোঁজ দিচ্ছিলো তখন একটি পৈশাচিক হাসির শব্দ নেপথ্যে শোনা যাচ্ছিলো। এর মধ্য দিয়ে রাজাকারদের হীন চরিত্র ও মনের পৈশাচিকতার একটা স্বরূপ দর্শক অনুভব করতে পারবে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য হিসেবে এ ছবিতে একটি বিষয় ছিলো অনুপস্থিত। তা হলো যুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান-চীন-আমেরিকা-রাশিয়া যে অবস্থান ও দ্বন্দ তা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এ ছবিতে। সে অর্থে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিকতার পরিবর্তে যুদ্ধের একটি খণ্ডচিত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে এ সিনেমাটি।

এ ছবিতে সিনোম্যাটিক উপাদানের কিছু ঘাটতি ছিলো। গল্প বা কাহিনীকে প্রতিষ্ঠা করার বদলে নির্মাতা যেন গোটা মুক্তিযুদ্ধকেই দু’ঘন্টার ফ্রেমে বাঁধতে চেয়েছিলেন। ফলে সিনেমার পাত্র-পাত্রীদের মাঝে কার সাথে কার কী সম্পর্ক তা বুঝে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়। এছাড়া প্রথমভাগে ঘটনাপ্রবাহের অতিমাত্রায় দ্রুতগামিতা ও শেষভাগে এসে মন্থরতা চিত্রনাট্যের বিন্যাস ও বিভাজনের দুর্বলতারই ইঙ্গিত দেয়।

তবে নানা ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাধীনতা পরবর্তী সংকটপূর্ণ সময়ে এমন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ নি:সন্দেহে কলাকুশলীদের সাহসিকতা ও আন্তরিক সদিচ্ছারই পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের ছবি হিসেবে ‘ওরা ১১ জন’ তাই চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবে।