এক সাগর রক্তের বিনিময়ে: কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’- স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া এমন কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই গান যাকে অনুপ্রাণিত করেনি। ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে’ গানটি আজও গণজাগরণের চেতনা জাগায় নতুন প্রজন্মের মধ্যে। আর বিজয়ের দিনের গান ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ মনে করিয়ে দেয়, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতার কথা।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2016, 07:54 AM
Updated : 16 Dec 2016, 02:34 PM

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ তৈরি হয়েছিল বাঙালির নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে। সেই চলচ্চিত্রের মূলসুরকে জাগিয়ে তুলতে ব্যবহার করা হয় আপেল মাহমুদ-এর সুরারোপিত, গোবিন্দ হালদারের কথায় আর স্বপ্না রায়ের কণ্ঠে গাওয়া গান ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’।

বিজয়ের দিনে এই গানের সংগীত পরিচালক আপেল মাহমুদ বললেন এই গান ঘিরে তার অভিজ্ঞতা, অভিযোগ ও যুদ্ধদিনের স্মৃতির কথা।

‘ওরা ১১ জন’-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ

শুরুতেই তিনি তুলে ধরেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই গান অনুমতি না নিয়েই ‘ওরা ১১ জন’-এ ব্যবহার করার অভিযোগ।

“প্রথমত এই গানটা খুব অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছে তারা। তারা আমার কাছ থেকে পারমিশন নেয়নি। আমি তাদেরকে উকিল নোটিশ সার্ভ করেছিলাম, চাষী নজরুল সাহেবকে। যা হয়, সে শক্তিশালী ছিল, রাজনৈতিক দল তার সাপোর্টে ছিল, আমার উকিল নোটিশকে সে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু, অপরাধ সে করেছে। আজকে সে নাই, ওই অপরাধের বোঝা নিয়েই সে কবরে গেছে,” অনেকটা অভিমান নিয়েই বলেন তিনি।

তবে অভিমানের সেই কাল মেঘ দ্রুত কেটে যায় গানটি তৈরির পেছনের গল্প বলতে বলতে।

“মুক্তিযুদ্ধের শেষপ্রান্তে বিজয় দিবসের দিন শহীদদের স্মরণে গানটি করা হয়েছিল। এটা লিখেছিলেন গোবিন্দ হালদার। উনি কলকাতার। অত্যন্ত সাদাসিধে একজন মানুষ, অসংখ্য গান তিনি লিখেছিলেন, কিন্তু সেভাবে মূল্যায়ণ হয়নি। আমিই প্রথম তার শতশত গানের মধ্যে কিছু গান করেছি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে থাকতে। আর ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ বিজয় দিবসের দিনই বেজেছে।”

গানটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, “এটার সুর করতে গিয়ে আমি লক্ষ শহীদের কথা ভেবেছি। গানটাকে আমার কিছুটা রিরাইট করতে হয়েছে, টিউনিং-এর সুবিধার জন্য। যেহেতু এই গানটি শহীদদের স্মরণে, আমাকে খেয়াল রাখতে হলো, মেলোডির যেন কোনো কমতি না হয়, সুরের যেন বৈচিত্র থাকে। সুরের যেন একটা অ্যাট্রাকশন থাকে, একটা ম্যাগনেটিক পাওয়ার থাকে।”

স্বপ্না রায় ও গোবিন্দ হালদার-এর গল্প

আপেল মাহমুদ-এর স্মৃতিচারণায় উঠে এলো গানটির গায়িকা স্বপ্না রায়-এর কথা। শরণার্থী শিবিরের ঘরছাড়া, দিশেহারা মানুষদের সাহস যোগাতে গিয়ে কীভাবে দেখা হয়েছিল কুমিল্লার কলেজ পড়ুয়া স্বপ্নার সঙ্গে, সে গল্পও করলেন তিনি।

“গানটি যিনি গেয়েছেন, উনি বাংলাদেশেরই - বাড়ি কুমিল্লা। তিনি স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। গানবাজনা করতেন।”

স্বাধীন বাংলঅ বেতার কেন্দ্রে যোগদানের আগে আপেল মাহমুদ অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করছিলেন তিন নাম্বার সেক্টরে। যুদ্ধের এক পর‌্যায়ে দলের অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তিনি ভারতের শিমলাতে আশ্রয় নেন।

গোবিন্দ হালদার: ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটির রচয়িতা ছিলেন গোবিন্দ হালদার

“সেখান থেকে আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লিগের শফি ভাই (ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া বাড়ি), কর্নেল ওসমানি, এম আই সিদ্দিকী সাহেব (পার্লামেন্ট-এর মেম্বার) আগরতলায় নিয়ে যান। তখন [আব্দুল] জব্বার ভাইও যান,” জানান তিনি।

“আমাদের দুজনকেই তখন আগরতলার চিফ মিনিস্টার অনুরোধ করেন শরণার্থীদের সাহার‌্যার্থে অনুষ্ঠান করতে। ওখানে যারা বাংলাদেশের শিল্পী ছিল, তাদের মধ্যে স্বপ্না রায়ও ছিলেন, নমিতা ঘোষ ছিলেন, মাধুরী আচার‌্য ছিলেন। সেখান থেকে তাদেরকে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জয়েন করি।”

তিনি আরও বলেন, “উনি খুব সুকণ্ঠী ছিলেন। আরও অনেকগুলি গানই গেয়েছেন। এই গানটির উনি নেতৃত্বে ছিলেন। ‘ওরা ১১ জন’-এ ওর কণ্ঠটাই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যেটা করার কথা ছিল, সেটা করেনি। ওর নাম দেয়নি। এটা একটা স্বেচ্ছাচারিতার কাজ করেছে চাষী নজুরুল। সেটা আমি আজীবন মনে রাখবো।”

স্বপ্না রায়-এর মতো শিল্পীদের মনে রাখেনি বাংলাদেশ- এই কষ্ট তাকে পোড়ায়। তবে নিজে যুদ্ধ করে যে দেশটিকে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছেন, সেই দেশের কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা নেই এই শিল্পীর।

তার ভাষ্যে, “মূল্যায়ণ সম্পর্কে কোনো কথা বলবো না, মূল্যায়ণের জন্য যাইনি যুদ্ধে। আমি ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা মূল্যায়ণের জন্য যুদ্ধে যাইনি, গিয়েছি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে। আমি প্রথমে সশস্ত্র যুদ্ধে যাই; মার্চ, এপ্রিল, মে- এই তিন মাস আমি প্রথমে ক্যপ্টেন মতিউর (পরে মেজর জেনারেল হলেন) এবং পরে ক্যাপ্টেন নাসিম (উনি বাংলাদেশের আর্মি চিফ হয়েছিলেন)-এর নেতৃত্বে বিভিন্ন জায়গায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিই। পরে পয়লা জুন-এ আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাই; কোনো প্রাপ্তির জন্য নয়। কারণ এদেশের কাছে প্রাপ্তির কিছু থাকলে, যিনি সেটা দিতেন, সেই বঙ্গবন্ধুই এখন আর নাই। সুতরাং আর কারো কাছে আর কিছু চাইনা।”

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব দূরে সরিয়ে তিনি বরং আগ্রহ দেখালেন ‘এক সাগর রক্তের’-এর গীতিকার গোবিন্দ হালদার-এর সঙ্গে তার কীভাবে দেখা হলো- সেই গল্প শোনাতে।

“গোবিন্দ হালদারকে ওইসময় সচক্ষে খুব কম মানুষ দেখেছে। আমাদের সঙ্গে তার শুধু কথাই হতো, দেখা আর হতো না। আমিই অনেকদিন পরে তার সঙ্গে দেখা করার উদ্যোগ নিই। তাকে একসময় বললাম, নিউ মার্কেটে আসেন। দুজনেই কী রঙের কাপড় পড়বো, সেটা ঠিক করলাম। উনি কী রকম দেখতে, সেটার সম্পর্কে আমাকে একটা ধারণা দিলেন। আমি বললাম, আমার কালো মোচ আছে। আমার মাথায় তখন প্রচুর চুল ছিল, সেটাও বললাম। দেখা হলো কলকাতা নিউমার্কেটের একটা ফলের দোকানের সামনে।”

“দুজনেই দুজনকে দেখছি, কিন্তু কথা বলছি না। শুধু ঘুরছি, দেখছি আর আড়ে আড়ে তাকাচ্ছি। তারপরে দা্দাই বললো - ‘এ্যাই, তুমি আপেল না?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ‘দাদা’ বলে জড়িয়ে ধরলাম।”

“ওখানে একটা পানের দোকান ছিল। সেই পান-সিগারেট বিক্রেতা চিৎকার করতে লাগলো, ‘এইযে দেখ, আপেল মাহমুদ, গোবিন্দ হালদার! আপেল মাহমুদ, গোবিন্দ হালদার!’ তার চিৎকার শুনে প্রায় শতাধিক লোক জমা হয়ে গেল!”- ওইদিনের কথা বলতে বলতে নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন আপেল মাহমুদ।

“এই প্রথম গোবিন্দদাকে দেখলাম। ওখান থেকে দাদার বাসায় গেলাম, দাদা খুব ছোট্ট একটা চাকরী করতেন, সরকারী চাকরি ছিল, এলাইজি কোয়ার্টারে থাকতেন। ওই বাসায় গেলাম, বউদির হাতের রান্না খেলাম। দাদার একটাই মেয়ে, গোপা। (মেয়েটা এসেছিলো, প্রধানমন্ত্রী যে উপহার দিয়েছিল, সেই উপহার নেওয়ার জন্য) ছোট্ট মেয়েটা তখন। আমি প্রায়ই তখন দাদাদের বাসায় যেতাম। গেলেই বৌদি খুব যত্ন করে খাওয়াতেন।”

“‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটির রিহার্সেলের জন্য আমি দদার কাছে রফিউল আলম, স্বপ্না, শ্যামল ভৌমিক, মাধুরী আচারর‌্যৗ, নমিতা ঘোষ, মঞ্জুর আহমেদ, শহীদ হাসান, কাদেরী কিবরিয়া- এদেরকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারা দেখেছে তাকে।”

যুদ্ধ ও বিজয়ের দিনের স্মৃতি

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেকর্ড এবং প্রচার হওয়া এই গানটি আপ্লুত করেছিল বিশ্বের সব প্রান্তের বাঙালিকেই। বাংলাদেশের জয়ে উল্লাসের বাঁধ ভেঙেছিল কলকাতার ঘরে ঘরেও। কিন্তু দায়িত্বের বেড়াজালে আটকে আড়ালে থেকেই নাকি বিজয় অনুভব করতে হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠসৈনিকদের।

তিনি বলেন, “দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, তখন তো কলকাতায় ছিলাম। কলকাতার লোকেরা খুব আনন্দ করেছে। আমাদেরকে ফোন করেছে আনন্দোৎসবে শামীল হওয়ার জন্য। শ্যামল মিত্রদা, অপরেশদা, বাসরীদি (বাপ্পী লাহিড়ির বাবা-মা), বরুণদা, অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, খ্যাতনামা শিল্পী পিন্টু ভট্টাচারর‌্য- উনারা ফোন করছেন, দাওয়াত দিচ্ছেন, বলছেন ‘এসো’; কিন্তু আমরা তখন খুব ব্যস্ত ছিলাম গান নিয়ে, রেকর্ডিং নিয়ে।”

“স্বাধীনতা অর্জনের দিনে একাধিক গান রেকর্ড হয়েছে এবং বেজেছে। প্রচণ্ড আনন্দ হয়েছে, কিন্তু আমরা তো বাইরে যেতে পারতাম না! আমি, এম আর মুকুল (চরমপত্র যিনি পড়তেন), আর জব্বার সাহেব- আমাদেরকে সরকার নির্দেশ দিয়েছিল যেন বাইরে না যাই। কারণ একটা অ্যাটেম্পট হয়েছিল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার; কার‌্যক্রমের মাধ্যমে যাদের নাম ছড়িয়ে গেছে, তাদের একটা কিছু ক্ষতি করার। আর তাই আমরা তিনজন, ইচ্ছা করলেও বাইরে যেতে পারতাম না।”

 

“আমরা শুনতে পাচ্ছি সারা কলকাতাই আনন্দে মেতেছে, বাজি পোড়াচ্ছে, ফায়ারওয়ার্কস হচ্ছে, এই হচ্ছে, সেই হচ্ছে, আনন্দ মিছিল হচ্ছে! যাওয়ার ইচ্ছা ছিল অনেক, কিন্তু কাজের কারণেই যেতে পারিনি। সে আনন্দটুকু উপলব্ধি করেছি, উপভোগ করেছি, দেখতে পাইনি সরাসরি,” যোগ করেন তিনি।

কেবল সাংস্কৃতিক যুদ্ধেই নয়, সম্মুখ সমরেও জীবন বাজি রেখে লড়েছেন শত্রুর সঙ্গে। সেইসব সময়ের কোনো বিশেষ স্মৃতি কি নেই, যা তাড়িয়ে ফেরে আজও?

আপেল মাহমুদ বললেন, “পুরো যুদ্ধটাই তো মৃত্যুর আগ পর‌্যন্ত ভোলা যাবে না। আসলে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তই তো একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা মনে হয় আমার কাছে। তখন প্রতিটি মুহূর্তই ছিল মূল্যবান। কারণ, এই মুহূর্তেই আপনি বেঁচে আছেন, পরের মুহূর্তেই একটা গুলি… আপনি শেষ! সুতরাং, সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সময়কে ভিন্ন করে আমি দেখি না।”

তিনি আরও বলেন, “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও পরম শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন - ‘তোমরা একটি মুহূর্তও বিফলে যেতে দিও না। সময় খুবই অল্প, মুক্তিযোদ্ধারা বেশিদিন বাঁচে না। এই স্বল্প সময়েই তোমাদের সবকিছু করে যেতে হবে। প্রতিটি নিঃম্বাসে আমিাদেরকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’ সুতরাং তাই করার চেষ্টা করেছি।”

তবে যুদ্ধের ময়দানে নিজের সবচেয়ে বড় সঙ্গীর কখা উল্লেখ না করে পারলেন না।

বললেন, “২৫ মার্চ রাতে আমার হাতে আর্মস আসে। সেটা আরেক বিশাল ঘটনা। ওই রাতে তো আমি গুলি করি নাই; আমার হাতে ছিল শুধুই নিথর একটা অস্ত্র। ওটাই ছিল আমার যুদ্ধের সবচেয়ে বড় সঙ্গী; পরবর্তীতে ওটা দিয়েই আমি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, গুলি ছুঁড়েছি, শত্রু হনন করেছি।”

বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে

যুদ্ধ শেষে ঘরে ফেরার পালা। তবে ফিরতে চাইলেও, এতো সহজে কি ছুটি মেলে? কয়েকদফার আসা-যাওয়ার পালা শেষে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফেরেন তিনি।

“আমি ১৮-১৯ তারিখের দিকে একবার ফিরেছি। ফিরে আম্মাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, পেলাম না। আমার আবার একটা রেকর্ডিং চলছিল সেখানে (কলকাতায়); খুব বড় একটা লংপ্লে বের হবে, আর দুটো শর্টপ্লে। এগুলো নিয়ে আমি মহাব্যস্ত ছিলাম। তাই আবার ফিরে গেলাম ২২ কি ২৩ ডিসেম্বরে। আবারও ডিসেম্বরের শেষেই এসেছিলাম, মাকে খোঁজার জন্যই।”

“তারপর আসলাম, বঙ্গবন্ধু যেদিন ফিরলেন, তার আগেরদিন, ৯ জানুয়ারি। তারপর ১১ জানুয়ারি তার সঙ্গে দেখা করলাম, ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর বাড়িতে। ওখানেই শেখ হাসিনা থাকতেন, ওখানেই বঙ্গবন্ধু উঠলেন।”

“তবে একেবারে ফিরলাম ফেব্রুয়ারিতে, ‘বিক্ষুব্ধ বাংলা’ নিয়ে। এটা বঙ্গবন্ধুর উপরেই একটা লংপ্লে ছিল। এটার স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছেন দেবেশ সোম। আমি আর জাব্বার ভাই গান করেছিলাম; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনেক শিল্পীই ছিলেন। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় স্ক্রিপ্টটা পড়ে দিয়েছিলেন। সেটাই বঙ্গবন্ধুকে প্রেজেন্ট করতে এলাম। উনি মহা খুশি হলেন। খুব আদর করলেন। আমাদের খোঁজ নিলেন।

আমাকে ‘আফেল’ ডাকতেন, জাব্বার ভাইকে ‘জোব্বার’।”

যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পল্টন ময়দানে ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এক বিরাট জনসভার আয়োজন হয়েছিল, তার পেছনের কারিগর ছিলেন তিনিই।

“এসেই আবার যেতে হলো, কারণ ২১ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু সত্যজিৎ রায়, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখপাধ্যায়দেরকে আনতে বললেন। এবং উনাদেরকে আমি নিয়ে এসেছিলাম। ৭২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে পল্টনে প্রায় ৩০-৪০ লক্ষ লোক হবে, সেখানে উনারা উপস্থিত ছিলেন।”

কেবল বঙ্গবন্ধুই নয়, মওলানা ভাসানির সান্নিধ্যেও তিনি এসেছিলেন ওই সময়ে।

দু্ই কিংবদন্তীর সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, “আমার মনে পড়ে, মৌলানা ভাসানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাচ্ছেন টাঙ্গাইলে, উনার এলাকায়। তো, আমি আর আব্দুর রউফ ভাই, নাদিরা আপাও সঙ্গে যাচ্ছি। তো ঢাকা থেকে যখন রওনা দিলাম, তখন ঢাকা থেকেই শুরু হয়েছে, প্রায় দু’শোর উপরে গেট তৈরি হয়েছে, এবং এই গেটগুলি গুণছে আব্দুর রউফ ভাই। সেইসব গেটে একটার পর একটা আমাদের গানের কলি লেখা!”

“ভাসানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন, বঙ্গবন্ধুও ভাসানীকে পিতৃশ্রদ্ধায় আপ্লুত করে রাখতেন। এবং এটা আমার খুব কাছ থেকেই দেখা। আমরা যখন মঞ্চে গান গাইতে উঠবো, তখন তিনি বললেন, ‘তুই কিন্তু ওই গানটা গাবি, মুজিবকে নিয়ে যেটা লিখেছিস - মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি - ওইটা!’”

স্বাধীনতাকে রূপক অর্থে ব্যবহার করা এই গানটি যে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার রূপকারকে নিয়েই লেখা, এই কথা ফাঁস করলেন তিনি সবশেষে!

“বঙ্গবন্ধু ভাবতেন এই গানটা তাকে নিয়ে লেখা। মানুষ এখনও আমাকে প্রশ্ন করে দেশে-বিদেশে। আমিও এটাই বলি!”