দুই দশক পুর্তিতে মনিপুরি থিয়েটারের পাঁচদিনের নাট্যোৎসব

মনিপুরি সংস্কৃতি ও ভাষা রক্ষায় দলগতচর্চার দুই দশক উদযাপনের ধারাবাহিক আয়োজনে এবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়পাঁচদিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছে মনিপুরি থিয়েটার। ‘অঙ্গে রঙ্গে কথায় ছন্দে জাগো’- স্লোগান নিয়ে এবারের উৎসবে দলটি মঞ্চস্থ করবেতাদের আলোচিত ৫টি নাট্য প্রযোজনা।

গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2016, 03:59 PM
Updated : 10 Dec 2016, 05:58 AM

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনাদের গাথা নিয়ে ‘কহে বীরাঙ্গনা’, এক বন্ধ্যা নারীর সন্তান-আকাঙ্ক্ষা আর সম্পর্কের ত্রিমুখি দ্বন্দ্ব নিয়ে  ‘লেইমা’ (লোরকার‘ইয়ের্মা’ থেকে), , মণিপুরি মৃদঙ্গবাদকের করুণ কাহিনির মধ্য দিয়ে প্রান্তজীবনের বিপর্যয়ের গল্প নিয়ে ‘ইঙাল আঁধার পালা’, ধর্মের অন্ধতা ও ক্ষমতার দাপটে সামান্য কথার সূত্রে এক শিশুকে জোরপূর্বক সমুদ্রে বিসর্জনের মর্মান্তিক কাহিনি ‘দেবতার গ্রাস’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে)এবারের উৎসবে প্রদর্শন করবে দলটি।

সেগুনবাগিচার জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চ ও পরীক্ষণ থিয়েটারে অনুষ্ঠিতব্য এ উৎসব আগামী ২৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে এ উৎসব চলবে২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

১৯৯৬ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া মনিপুরি থিয়েটারের শেকড় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ঘোড়ামারা গ্রামে। সেখানকার মনিপুরিসম্প্রদায়ের অধিবাসিদের নিয়ে গড়ে উঠেছে দলটির কার্যক্রম। মনিপুরি সংস্কৃতির আঙ্গিক ও উপাদানগুলো অক্ষুণ্ন রাখতেই মঞ্চে দলগতভাবে দীর্ঘদিন ধরে নাট্যচর্চা করে যাচ্ছে দলটি। ২০ বছরের পথ চলায় ত্রিশটি প্রযোজনার মধ্যে ১৮টি নাটকই মনিপুরি ভাষায়, দশটি বাংলা ও দুটি উভয় ভাষার মিশ্রনে তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শুভাশিস সিনহা।

নাটকগুলোর চার শতাধিক মঞ্চায়ন হয়েছে। এছাড়াও ঐতিহ্যের নিরীক্ষায় মণিপুরি থিয়েটার মঞ্চে এনেছে রাসলীলা, নটপালা, ধ্রুমেল, হোলি সহ আরও নানান পরিবেশনা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে নাটক মঞ্চায়ন করে মণিপুরী থিয়েটার। বর্তমানে দলটির সদস্য সংখ্যা পঞ্চাশ।কলমগঞ্জ উপজেলার ঘোড়ামারা গ্রাম ও তার আশেপাশের গ্রামের মনিপুরি সম্প্রাদায়ের তরুণরাই এ দলের প্রাণ।

দুই দশক ধরে মনিপুরি থিয়েটারের নাট্যচর্চা প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শুভাশিস সিনহা গ্লিটজকে বলেন, “বাংলাদেশের মণিপুরি জাতি সত্তার সংস্কৃতির ঐতিহ্যের নানান উপাদানকে আমরা থিয়েটারের ভাষায় যেমন দেশের মানুষের সামনে হাজির করতে চেয়েছি, তেমনি চেয়েছি একটি সংকটাপন্ন ভাষাকেও থিয়েটারের আঙ্গিকে বাঁচিয়ে রাখতে। আবার এই বাংলার নাট্যভাষার বৈচিত্র তৈরি করতে, ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় বাংলারথিয়েটারকে সমৃদ্ধ করতেও আমাদের এই তৎপরতা কিছুটা সাহায্য করেছে বলে মনে করি। মাত্র ১ লাখ জনসংখ্যার একটি জাতিসত্তার মুখপাত্র হিসেবে এ নাট্যদল আজ দেশের মানুষের আগ্রহ, আকর্ষণ ও ভালোবাসার বিষয় হয়ে উঠেছে, সে আমাদেরকে আনন্দিত করে।”

নাট্যচর্চার পাশাপাশি মণিপুরি থিয়েটার নিয়মিত প্রকাশ করছে রৌদ্রজলের পঙ্ক্তিমালা এবং মণিপুরি থিয়েটার পত্রিকা। দলটি মণিপুরিদেরঐতিহ্যবাহী বিষু পর্বটিকে নিয়ে উৎসবের আয়োজন শুরু করে ১৯৯৭ সালে। আজ অবধি প্রতি বছর ঘোড়ামারা গ্রামের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বর্ণাঢ্য বিষুউৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে। এতে প্রতি বছর দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ ভাবচিন্তার সম্মেলনে শরীক হন।

শুভাশিস সিনহা আরও বলেন, “গ্রামে গ্রামে ঘুরে, রাস্তায় মঞ্চ বেঁধে, মণ্ডপে তৎক্ষনাৎ পাটি বিছিয়ে দর্শক বসিয়ে যে নাট্যধারা আমরা বেগবান রেখেছি, সেখানে আজ নতুন সংযোজন আমাদের নিজেদের তৈরি গ্রামীণ থিয়েটার স্টুডিও ‘নটমণ্ডপ’। বাঁশ মাটি আর টিনের তৈরি এই স্টুডিওতে আজ দর্শক টিকেট কেটে নাটক দেখে। ঢাকা থেকে প্রথম সারির নাট্যদল এসে নাটক করে যাচ্ছে। প্রান্ত আর কেন্দ্রের এই মিলন, এই সাংস্কৃতিক বিনিময় আমরা চেয়েছি, আজ তা সফল হতে চলেছে। তারুণ্যের শক্তিতে, দেশ আর জাতিসত্তার প্রেমে ভালোবাসায় নিরন্তর আমাদের পথচলা, নাট্যশিল্প-নন্দন দর্শন যেখানে একাকার হয়ে চলেছে শ্রমের শক্তিতে। কেবল প্রাণশক্তি, শ্রম, ভাবনা আর কাজ এ নিয়েই মণিপুরি থিয়েটার।”