‘আমরা সবাই কুবরিক-এর সন্তান’

বেঁচে থাকলে জুলাইয়ের ২৬ তারিখে নির্মাতা স্ট্যানলি কুবরিক এর বয়স হতো ৮৮ বছর। কুবরিক কেবল একজন সফল নির্মাতাই ছিলেন না, পরবর্তী প্রজন্মের পরিচালকদের জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটি বিশ্বাস,একটি দর্শনের নাম।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2016, 07:59 AM
Updated : 29 July 2016, 07:59 AM

ব্যক্তি কুবরিককে বিশ্লেষণ করাটা সহজ হলেও, কঠিন তার সিনেমা নিয়ে কথা বলাটা। অনেকের মতে, পশ্চিমা বিশ্বের রূপালি জগৎকে বিষয়বস্তু এবং দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে নতুন এক যুগে প্রবেশ করান তিনিই।  

৪৪ বছরের ক্যারিয়ারে স্ট্যানলি কুব্রিকের নির্মিত মোট সিনেমার সংখ্যা মাত্র ১২ টি। এরমধ্যে আবার ১৯৯৯ সালের ‘আইজ ওয়াইড শাট নির্মানের আগে প্রায় বারো বছর কোন সিনেমাই বানাননি তিনি।

কিন্তু তারপরও হলিউড সিনেমার এহেন কোন ঘরানা নেই যেখানে কুবরিক-এর ছোঁয়া নেই। সাই-ফাই ( টু থাউস্যান্ড ওয়ান: আ স্পেস ওডিসি), ওয়ার (ফুল মেটাল জ্যাকেট), সোর্ড অ্যান্ড স্যান্ডাল (স্পার্টাকাস), ডিস্টোপিয়ান (অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ), হরর (দ্য শাইনিং), নয়্যার (দ্য কিলিং) কিংবা পলিটিক্যাল ব্ল্যাক কমেডি (ডঃ স্ট্রেঞ্জলাভ)- সব ঘরানাতেই নিজের স্বাক্ষর রেখে গেছেন এই নির্মাতা।

সিনেমা নির্মাতা থেকে সমালোচক, কুবরিককে চলচ্চিত্র  ইতিহাসের অন্যতম সেরা পরিচালকদের একজন বলতে আপত্তি নেই কারো। যুগযুগ ধরে তার কাজে প্রভাবিত হয়েছেন অনেক পরিচালক। হলিউডের মার্টিন স্করসেসি থেকে মাইকেল মান কিংবা ক্রিস্টোফার নোলান থেকে ডেভিড ফিঞ্চার, বলিউডের দিবাকর ব্যানার্জি আর অনুরাগ কাশ্যপদের সবারই কিছু না কিছু দেনা আছে কুবরিক-এর কাছে।

হালের প্রখ্যাত যতো সাইকো-থ্রিলার সিনেমা নির্মাতা আছেন তাদের মধ্যে সবার আগে যে নামটি আসে তা হলো ক্রিস্টোফার নোলান। কুবরিককে নিয়ে যিনি বলেন, “ সিনেমায় গল্প বলার ধরন থেকে শুরু করে নির্মান শৈলী সবখানেই কুব্রিকের সাথে একটি যায়গায় আমার সম্পর্কটা বেশ নিবিড় আর সেটা হলো‘প্রশান্তি’। তার প্রতিটি সিনেমার প্রতিটি চিত্রায়নে এমন অন্তর্নিহিত প্রশান্তি আর শক্তিশালী উপস্থাপন রয়েছে, যা দেখে আমি নিজের কাজ নিয়েই লজ্জা পাই। সিনেমার গল্পকে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে যেখানে সাউন্ড, ইফেক্ট, শট নিয়েয়ামদের রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়, কুবরিক-এর একটি প্রশান্ত দৃশ্যায়নই সেখানে যথেষ্ট।”  

“চল্লিশ বছর হয়ে গেলো আমরা এখনও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি তাঁর সিনেমার দৃশ্য আর দর্শনের কোনটাই। একটা সিনেমার কাছে এর চেয়ে বেশি কি চাইতে পারি আমরা? শৈল্পিক আর প্রযুক্তিগত অর্জনের জন্য তার ‘টু থাউস্যান্ড ওয়ান: আ স্পেস ওডিসি’ এখনও আমার কাছে চলচ্চিত্রের সংজ্ঞা”, কুবরিককে নিয়ে টাইম আউট ডটকমকে এমনটাই বলছিলেন ‘এলিজাবেথ’ আর ‘ব্যান্ডিট কুইনের’ নির্মাতা শেখর কাপুর।

‘গ্ল্যাডিয়েটর’, ‘প্রমিথিউস’, ‘অ্যালিয়েন’ আর ‘ব্লেড রানার’-এর মতো দুনিয়া কাঁপানো সিনেমাগুলো নির্মান করেছেন রিডলি স্কট। অস্কারজয়ী এই নির্মাতার গুরুও কুবরিকই।

‘ডেইলি গ্যালাক্সী’কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে স্কট বলেন, “ ‘টু থাউস্যান্ড ওয়ান: আ স্পেস ওডিসি’- এর পরপরই মৃত্যুবরন করে সাইফাই ঘরানার সিনেমা। এরপরের এই ঘরানার সিনেমায় আর কিছুই ‘অরিজিনাল’ নেই। আমরা এর পুরোটাই দেখে ফেলেছি আগেই।”     

‘রেইজিং বুল’, ‘দ্য ডিপার্টেড’, ‘উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট’-এর পরিচালক মার্টিন স্করসেসিও বিরাট ভক্ত কুবরিক-এর সিনেমার। তিনি বলেন, “কুবরিক-এর সিনেমা দেখা অনেকটা পর্বতের চূড়া দেখার মতো। আপনি ওপরে তাকাবেন আর ভাববেন, এতো ওপরে কি কারো পক্ষে আদৌ যাওয়া সম্ভব!”

‘দেয়ার উইল বি ব্ল্যাড’ পরিচালক পল থমাস অ্যান্ডারসন নিজেকে ভাবেন কুবরিক-এর সন্তান হিসেবে। অকপটে স্বীকার করলেন সিনেমা নির্মাণে কুবরিক-এর কাছে নিজের ঋণের কথা।

তিনি বলেন, “ আমরা সবাই তো কুব্রিকের সন্তান। তাই নয় কি? এমন কিছু কি আমাদের করার বাকী আছে যা কুবরিক করে যাননি? ‘দেয়ার উইল বি ব্ল্যাড’ এর অনেক শটই তার সিনেমার অনুকরণে নেয়া। এমনকি সিনেমার সমাপ্তিও আমাদের মনে করিয়ে দেয় ‘আইজ ওয়াইড শাট’-এর কথা।”

‘টুইন পিকস’ আর ‘মুলহোল্যান্ড ড্রাইভ’ এর স্রষ্টা ডেভিড লিঞ্চ বলেন, “ আমি কুবরিককে অসম্ভব রকমের পছন্দ করি। আমি মনে করে এই মূহুর্তে সে সবচেয়ে আধুনিকদের একজন। ‘দ্য শাইনিং’-এর ভূত এখনো তাড়ায় আমাকে। এখনও ক্যাবল নেটওয়ার্কে সিনেমাটি চললেই দেখি আমি। আমার কাছে তাঁর সেরা সিনেমা এটি।”

বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক, ‘ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বকশী’, ‘ওয়ে লাকি! লাকি ওয়ে’, ‘লাভ, সেক্স অউর ধোকা’ সিনেমার নির্মাতা দিবাকর ব্যানার্জি মুগ্ধতা প্রকাশ করেন, কুবরিকের প্রযুক্তি ব্যবহারের নৈপূণ্য নিয়ে।

তিনি বলেন, “ প্রত্যেক অসাধারণ নির্মাতাই একেকজন অসাধারণ কারিগর। কুবরিক তার জীবনে নেয়া প্রতিটি শট এর বিস্তারিত বর্ণনা দিতে পারবে আপনাকে। ক্যামেরা, অপটিকস আর লেন্স নিয়ে এতো বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন তিনি, যা রীতিমত তাকে এই ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ করে তুলেছিল। আর আপনি যদি এই ব্যাপারগুলো ঠিকমতো নাই বুঝেন, তাহলে তো আপনি গল্পের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শটই নিতে পারবেননা।”

আসলে মরেও চিরকাল অমর থাকবেন স্ট্যানলি কুবরিক। ঘুরে ফিরে তিনি বারংবার আসেন আমাদের মাঝে। হোক সেটা ‘দ্য শাইনিং’ এর ভূত হয়ে কিংবা তরুন কোন চলচ্চিত্র নির্মাতার কুবরিক স্টাইলের শট এর মধ্য দিয়ে। কারণ কুবরিকরা মরে না।