‘বাপিই ছিলেন আমাদের সুপারম্যান’

জিনাত সানু স্বাগতা, খৈয়াম সানু সন্ধি আর কারিশমা সানু সভ্যতা- এই সময়ের সাড়া জাগানো তিন তরুণ তারকা। তিন ভাই-বোন মিলে ছোটবেলা থেকেই মেতেছিলেন গানের বিশাল জগত নিয়ে। আর সংগীতের এই পথচলায় তাদের অনুপ্রেরণা এবং পথ প্রদর্শক হয়ে ছিলেন তাদের বাবা প্রয়াত সঙ্গীত পরিচালক খোদা বক্স সানু।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2016, 12:16 PM
Updated : 19 June 2016, 12:26 PM

বাবা দিবসে তিনজনই স্মৃতিচারণে তুলে আনলেন তাদের প্রিয় 'বাপি'কে।

বাপির কাছে খেলতে খেলতেই গান শিখেছি: সন্ধি

তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, একটা সাইকেল চাই-ই চাই। বাসার একটা নিয়ম ছিল যে, খুব দরকারি কিংবা জরুরি যে জিনিস হলেই সেটা চাওয়া যাবে। অদরকারি জিনিস পাওয়া যাবেনা, আবার সব চাইলেই পাওয়া যাবেনা। চাইলে তারপর সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তারপর সময়মত সেটা পাওয়া যাবে।

এরকমই তখন বাপির কাছে সাইকেল চেয়ে বসলাম। তখন বাপি বললো, আচ্ছা যেহেতু জরুরি এটা, দিচ্ছি তোমাকে। সাতদিন পরে বাপি সাইকেলটা নিয়ে আমাকে দিলো।

সেই সাইকেলটা আমার বাপি কিনেছিল কাগজপত্র বিক্রি করার ভাঙ্গারি দোকান থেকে কেজি দরে! দাঁড়িপাল্লায় ৭০০/৮০০ গ্রাম কেজির দরে উঠিয়ে সে আলাদা করে সাইকেলটা কিনেছিলো। কিনে সে এটাকে রিকশার গ্যারেজে নিয়ে গিয়েছিলো। সেখানে টিউব ঠিক করে, টায়ার লাগালো। আগে যে প্যাডেল ছিল, সেটা ছিল ভাঙ্গা। সেটাতে রিকশার প্যাডেল-ট্যাডেল লাগিয়ে দিলো। আগের সাইকেলে গিয়ার ছিলো, সেগুলো ফেলে নরমাল ফিক্সড গিয়ারের একটা চেইন লাগিয়ে দিলো। সবমিলিয়ে; সাতদিন পর আমার বাপি ১১০০ টাকা খরচ করে আমাকে একটা সাইকেল বানিয়ে দিলো!

বাসায় আরও সাইকেল ছিলো, স্বাগতা আপুর কিংবা বাপির- কিন্তু এটা ছিলো আমার প্রথম সাইকেল; বাপির দেওয়া।

বাপি যখন আনন্দম সঙ্গীতাঙ্গনে বাচ্চাদের গান শেখাতো, তখন কিন্তু আমরা একদম হাত ধরে শিখতাম না। আমরা তার কোলে বসে থাকতাম, পাশে বসে থাকতাম, শিখে যেতাম। ক্লাসের আগে কিংবা ক্লাসের পরে আমরা হারমোনিয়াম নিয়ে খেলতাম, তবলা বাজাতাম। খেলতে খেলতেই বলতে গেলে গান শিখেছি। 

আমার প্রথম সাউন্ড কার্ডের দাম ছিলো ১৮ হাজার টাকা। এটা কেনার জন্য আমার বাপি আমাকে ৮ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন। এটা বড় ধরণের একটা সাপোর্ট ছিল, আমার ক্যারিয়ারের শুরুতে। পরে তাকে আমি ধার শোধ করে দিই।

এরপর হয়তো স্পিকার কিনবো, তখন হয়তো কিছু কম পড়েছে- সে আমাকে ধার দিয়েছে। আমি আয় করে তাকে আবার ফেরতও দিয়েছি। এমনকি, প্রথম গিটারটাও কিনে দিয়েছিল বাপি। ছোট ছিলাম, সিক্সে পড়তাম- গিটার বাজাতে পারতামনা। সেসময় একদিন বাপি গিটার কিনে নিয়ে আসে। বাপিও কিন্তু বাজাতে পারতোনা, কিনে নিয়ে আসছিলো কোন কারণ ছাড়াই। পরে গিটার বাজানো শিখেছি ক্লাস টেনে উঠে।   

একটা কনসার্টের কথা মনে পড়লো, তখন আমার এস.এস.সি পরীক্ষার আগে টেস্ট চলছে। অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন আমি মধুবাগের একটা গলির মধ্যে কনসার্ট করতে গিয়েছি। আগামীকাল অঙ্ক পরীক্ষা, তাই বাসায় বলাই যাবেনা কনসার্টের কথা।

কনসার্ট শুরু হবার কথা সন্ধ্যা ছয়টায়, কিন্তু শুরু হতে হতে বেজে গেলো রাত আটটা। তখন রাতের বেলা বাসার বাইরে থাকা নিষেধ, হাতে মোবাইলও নাই। তখন বাপি বের হয়েছিল আমাকে খুঁজতে। মধুবাগের স্টেইজে আমি তখন মাইলসের 'ফিরিয়ে দাও' গাইছি। সে আমাকে খুঁজে পেল গলিতে, স্টেইজের সামনে এসে দাঁড়ালো। দেখলাম, সে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে!

এখন তো আমি নিজেও বাবা, আমার মেয়ে সংস্কৃতির বয়স এখন ছয় মাস। এখন প্রতিটি মূহুর্তে মূহুর্তে বুঝি, বাবা-মা আমাদের নিয়ে কতোই না ভাবেন। প্রতিটি মূহুর্তে অবাক হই, সংস্কৃতি আমাদের প্রতিটি মূহুর্তে অবাক করে। এখন বুঝতে পারি, বাবা আমাদের নিয়ে কতোই না চিন্তা করতেন।

জীবনের পুরোটাই ছিল বাপিময়: সভ্যতা

বাপির সঙ্গে আলাদা করে স্মৃতি আর কি বলবো! আমার জীবনের পুরোটা অংশই তো বাপিময় ছিলো। বাপির সঙ্গে এত ঘটনা, এত স্মৃতি- সেগুলো এক সঙ্গে মনে করাটা খুব কঠিন।

স্কুলে থাকা অবস্থায় বাপিকে বললাম সাইকেল কিনে দিতে, কিন্তু বাপি বললো- কেন, মোটর বাইক নিতে দোষের কি? কেমন না কেমন দেখাবে আমি আরও ভাবছিলাম, তখন বাপিই মোটর বাইক নিতে উৎসাহ দিলেন বেশি। এরপর সেই বাইক কেনা হলো, এখনও আমি ওটা ব্যাবহার করেই যাতায়াত করি। 

ছোটবেলা থেকেই বাপিকে দেখেছি ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আনন্দম সঙ্গীতাঙ্গনে গান শেখাতে। বাসা পুরোটা সময়েই গান চলতো। বাপি গান শেখাচ্ছেন, মজা করছেন সবার সঙ্গে- বাপি সবার খাতাতেই ক্যালিগ্রাফি করে তাদের নাম লিখে দিয়েছিলেন।

বাপি অসাধারণ একজন শিক্ষক ছিলেন, তার মত পর্যায়ে যাওয়া বোধহয় সম্ভব নয়। এখন আনন্দম সঙ্গীতাঙ্গন আমি দেখছি, এটা বিশাল বড় দায়িত্ব। বাপি চলে যাবার পর আমার ঠিক হতে সময় লেগেছে অনেক। ধীরে ধীরে সবকিছু কাটিয়ে উঠেছি, প্রায় দেড় বছর পর এখন আমি স্বাভাবিক। আনন্দম সঙ্গীতাঙ্গন আবার আগের মত ঠিক ঠাক করতে আমার ছয় মাস সময় লেগেছে। বাচ্চাদের মানসিকতা কিরকম হতে পারে, আমি আগে এগুলো জানতামও না।

আমাদের একজন মোটর সাইকেল ঠিক করার লোক ছিলো, বাদশা। তার কাছে আমি আর বাপি মিলে প্রায়ই আড্ডা দিতে যেতাম। বাদশা মামা বলতাম তাকে, তার খোঁজখবর এখন জানিনা। কিন্তু আড্ডার সময়টা জমতো অনেক, গল্প হতো মজার মজার। মাঝেমধ্যে বংশাল ঘুরতে যেতাম। বাপির সঙ্গে সত্যি বলতে প্রতিদিন একই কাজগুলোই করতাম। 

আমাদের নিয়ে বাপির কোনদিনই কোন প্রত্যাশার চাপ ছিলোনা। আমি যা করছি, সে তাতেই খুশি; দিদি যা করছে, সে তাতেই খুশি আর ভাইয়া যা করছে, সেটা নিয়েও সে খুশি। বাপির কোনদিন কোন প্রত্যাশাও ছিলোনা, কোন দুঃখও ছিলনা। আমরা যেমন ছিলাম, সেটা নিয়েই সে খুশি ছিলো। আমাদের কোনদিন কোনধরণের চাপ তিনি দেননি।

বাপি চলে যাবার সাতদিন আগে বান্দরবান থেকে এসছি আমি। আমি বাসায় ঢুকলাম সকালবেলা, সেই আমাকে দরজা খুলে দিলো। আমাকে সে জিজ্ঞেস করছে- “বান্দরবান কেমন? দার্জিলিং থেকেও সুন্দর?” আমি বলছি, “হ্যাঁ, দার্জিলিং থেকে্ও অনেক সবুজ।”

তখন সে বলছে- “আমি তো আর কোনদিন বান্দরবান যেতে পারবোনা।” আমি বলছি, “কেন?” "নাহ! ওসব জায়গায় যাওয়া আর হবেনা"- বাপির উত্তর ছিলো এটা। সত্যি সত্যিই এরপর আর কোথাও যাওয়া হয়নি বাপির। যখন গেলেন, তখন একেবারে না ফেরার দেশেই চলে গেলেন তিনি। 

বাপিই আমার সুপারম্যান:  স্বাগতা

আমাদের বাপি আমাদের কাছে সুপারম্যান! স্মৃতির কোন শেষ নেই। প্রতি মূহুর্তেই বাপি আমার সঙ্গে ছিলো।

আমি যখন প্রথম 'শত্রু শত্রু খেলা' শুটিং এ গেলাম, সময়টা ছিলো ২০০৬ সালের জানুয়ারি। সিনেমাটাতে যখন আমি অভিনয় করি, একেবারেই প্রস্তুত ছিলামনা আমি। তবে অনুপ্রেরণা ছিলো সবদিক থেকে, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এফডিসিতে কাজ করতে হলে নিজের সেরাটা দিয়েই কাজ করতে হবে।

১৭, ১৮ জানুয়ারি ছিলো প্রথম গানের শুটিং, আর ১৯ তারিখ ছিলো আমার জন্মদিন। জন্মদিনটা শুধু আমার একারই ছিলোনা, আমার বাপি আর আমার জন্মদিন ছিলো সেদিন। ১৬ তারিখ রাত থেকেই এফডিসিতে আমার সঙ্গে বাপি, মা ছিলেন। মান্না (প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্না) ভাই ছিলেন। তারা আমার সঙ্গে এক রাত থেকে আমাকে ওখানে রেখে চলে এসছেন। ১৮ তারিখ আমার শুটিং তখনও শেষ হয়নি, আর আমি চিন্তা করছি কিছুক্ষণ পরই তো আমার আর আমার বাপির জন্মদিন। আমি তখন ভাবছি, বাপির সঙ্গে মনে হয় দেখা হবেনা, কিভাবে আর শুভেচ্ছা জানাবো।

এই ভাবতেই রাতে দেখি সে মিষ্টি নিয়ে হাজির! সবাইকে বললাম আমাদের দু'জনেরই জন্মদিন। দারুণ দিন ছিলো সেদিনটা!

আমার বাপি সাধারণত আমার কোন কাজ নিয়ে খুব প্রশংসা করেনি। কোনকিছু বাড়িয়ে বা দিকনির্দেশনা দিয়ে তিনি কোন কিছুই আমাকে বলেননি।

বাপিই আমার সংগীতের শিক্ষক ছিলেন, সংগীত পরিচালকও ছিলেন। আমি যখন অন্য সংগীত পরিচালকের অধীনে কোনো কাজ করতাম, তখন তিনি কখনও একটা শব্দও উচ্চারণ করতেননা। এটা অদ্ভুত হলেও এরকমই হওয়া উচিত বাবাদের। আবার যখন তার সঙ্গে কাজ করেছি, তখন ঠিকই বাপি পথ দেখিয়েছেন। 

বাপি শেষ দিকে ফেইসবুক নিয়ে অনেক মেতে উঠেছিল। কিছুক্ষণ পর পর সে আমার খোঁজ নিতো। আমি উপরের ফ্লোরে থাকতাম, আর বাকিরা নিচের ফ্লোরে। কিছুক্ষণ পর পর দৌঁড়ে দৌঁড়ে এসে আমাকে বলতো, "শোন! শোন! ‘অমুক’কে খুঁজে পেয়েছি!"

তারপর আবার হুট করে জিজ্ঞেস করতেন, "পোক মানে কি? পোক?" তারপর আমি যখন মানে বুঝালাম, দেখলাম সে আমাকে পোক দিয়েছে। সে সারাদিন ফোন করে খোঁজ নিতো, "কোথায় তুই? কোথায় তুই? এখন কই?" ফেইসবুক আসার পর সে আমাদের চেক ইন দেখে লাইক দিতো। বাপি মারা যাবার পর দেখেছি, স্কাইপে, ওয়াটসঅ্যাপ, ভয়েস মেসেজে তার গান শেখানো। সুন্দর করে গান শেখাচ্ছেন। 

দুবছর প্রায় হয়ে গেলো। বাপিকে মিস করতে চাইনা। বাপির কথা মনে করলে কিছু করতে পারিনা। আমার মনে হয় পৃথিবীতে আমার থাকাই উচিত না। কারণ আমার জীবনে বাপি ছাড়া আর কিছু ছিলোনা। আমার কথার আগে বাপি, কথার পরে বাপি- সবখানেই তিনি ছিলেন।

তবে সেরা স্মৃতি একটাই বলবো। আমার স্কুল ছুটি মানেই বাপির সঙ্গে আমি টিউশনিতে যাবো, মজার মজার খাবার খাবো। এবং পুরো রাস্তায় বাপি আমাকে গান শেখাতো। আমি এভাবেই গান শিখেছি, বাইকে চড়ে।

আমি বাপির বাইকে সামনে বসতাম, আমার ছয়মাস বয়স থেকে বাপি আমাকে বাইকে নিয়ে রীতিমত গামছা দিয়ে বেঁধে টিউশনিতে নিয়ে যেত। আমার কোন অভিযোগ নেই তাকে নিয়ে। 

 ক্যাপশন: ছবি : ফেইসবুক থেকে নেওয়া