‘অন্যরকম রোমিও-জুলিয়েট’- এর গল্প

ঢাকায় আবারও মঞ্চায়িত হতে চলেছে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের করুণ প্রেমকাহিনি 'রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট'। তবে এবারের গল্পটি একটু অন্যরকম। ব্রিটিশ এই নাট্যকারের জন্মের চার শতক পূর্তী উপলক্ষে বৃটিশ কাউন্সিলের ‘শেকসপিয়র লিভস’ শীর্ষক আয়োজনে মঞ্চস্থ হবে ‘ আ ডিফারেন্ট রোমিও-জুলিয়েট’।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2015, 04:39 AM
Updated : 23 Nov 2015, 08:13 AM

নাটকটি অন্যরকম, কারণ এর অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীরা সবাই প্রতিবন্ধী। নাটকটি যৌথভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন যুক্তরাজ্যের গ্রেয়াই থিয়েটারের শিল্প নির্দেশক জেনি সিলি এবং ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু।

সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন ফর দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) বাংলাদেশ, ব্র্যাক, বাংলাদেশ রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ ফর ডেভেলপমেন্ট, গভর্নেন্স অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট (ব্রিজ) অ্যান্ড গ্রাম থিয়েটার থেকে আসা ১৬ জন প্রতিবন্ধী শিল্পী এ নাটকে অংশ নিচ্ছেন।

সাভারের ব্র্যাক ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে চলছে তাদের প্রস্তুতি পর্ব। রবিবার সকালে গ্লিটজ হাজির হয়েছিলো সেই পর্বে।

জেনি সিলি সাত সকালেই চলে এসেছিলেন। সহযোগী নির্দেশক হিসেবে ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের নবীন নাট্য নির্দেশক সামিউন জাহান দোলা। জেনি-দোলা মিলে মেতে উঠলেন শব্দ আর সুরের খেলায়। অভিনেতাদের বাচনভঙ্গি, বাচনকৌশল নিয়ে কাজ করছিলেন তারা দুজন।  অভিনয়শিল্পীদের কেউ বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী, কেউ আবার শারীরিক প্রতিবন্ধী, যন্ত্রসংগীতে যারা ছিলেন তারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। 

শব্দজটের খেলা শেষ হলে অভিনয়শিল্পীদের দলটি মেতে উঠলেন প্রতীকী ক্রিকেট ম্যাচে। মহড়াস্থলই হয়ে উঠলো স্টেডিয়াম। কেউ ছুঁড়লেন বল, কেউ ব্যাট হাতে সেই বলকে সীমানা ছাড়া করলেন, আর কেউ লুফে নিলেন দুর্দান্ত সব ক্যাচ।

মহড়ার ফাঁকে কথা হল নাটকের জুলিয়েট চরিত্রে রূপদানকারী জান্নাতুল ফেরদৌস স্মৃতির সঙ্গে। শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীর সঙ্গে সংযোগ করতে এগিয়ে এলেন প্রকল্পের অন্যতম প্রশিক্ষক মুর্শিদা ইয়াসমীন।

স্মৃতি বললেন, “আমি কখনো ভাবিনি, এত বড় মাপের আয়োজনে আমি অভিনয় করব। প্রথমে তো খুব ভয় পেয়েছিলাম পারবো কি না। কিন্তু প্রজেক্টের সবাই আমাকে ভীষণ সাহায্য করেছে রোমান্টিক জুলিয়েট চরিত্রটি করতে। এখন অপেক্ষা কবে মঞ্চে আমরা দর্শকের মুখোমুখি হবো।”

রোমিও চরিত্রে অভিনয় করছেন কেরানীগঞ্জের মোহাম্মদ রাব্বী মিয়া এবং মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সাদ্দাম হোসেন থাকছেন রোমিওর বন্ধুর চরিত্রে । শারীরিক প্রতিবন্ধী রাব্বী মিয়া এর আগে বিভিন্ন আসরে অভিনয় করেছেন। দর্শকের প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। 

“আমি এমন এক রোমান্টিক চরিত্রে কাজ করতে পারব, আমি ভাবিনি। আমার বাবা মালয়েশিয়া থাকেন। তিনি তো দেশে এসে অবাক। আমি এত বড় আসরে সুযোগ পাবো, তা বাবাও ভাবতে পারেনি। এ তো অকল্পনীয় এক সুযোগ।”

সাদ্দাম বলছেন, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি প্রমাণ করতে চান প্রতিবন্ধীরাও পিছিয়ে নেই। একটু সহযোগিতা পেলেও তারা নিজেদের প্রতিভার প্রমাণ রাখতে জানেন।

মহড়ার ফাঁকে কথা হলো নির্দেশক জেনি সিলির সঙ্গে। দলটি নিয়ে ভীষণ আশাবাদী জেনি স্বপ্ন দেখছেন বাংলার মঞ্চে নতুন এক ধারা উদ্ভাবনের। অন্যরকম কিছু নিয়ে সব সময়ই নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন বলে জানালেন।

২০১৩ সাল থেকেই ব্রিটিশ কাউন্সিলের এই প্রকল্পটি চলছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রতিবন্ধীদের শিল্পীদের থেকে সেরা ১৬ জনকে বাছাই করেছেন জেনি।

“এ প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেন না বধির ও স্বাভাবিক দৃষ্টি শক্তিহীন মানুষেরা কি করতে পারে- এ নিয়ে মানুষের ধারণা বদলে দেবে এ প্রকল্প। বিশ্বের অনবদ্য প্রেমাখ্যান ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর মঞ্চায়নে অংশ নেবে এসব শিল্পী। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা নতুন একটি পৃথিবী তৈরি করবো, যেখানে সবারই ভালোবাসার এবং ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার থাকবে।”

নাটকটি নির্দেশনার পাশাপাশি প্রযোজনা করছেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। জানালেন, শারীরিক প্রতিবন্ধীরা যেন শিল্পকলা একাডেমিতে সহজেই যাতায়াত করতে পারেন, সেজন্য বিশেষ এক প্রকল্প নিয়ে তিনি কাজ করছেন।

গ্রাম থিয়েটারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি গ্লিটজকে বলেন,“আমি যখন গ্রাম থিয়েটারে কাজ করি, তখন বেশ কজন শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পারফরম্যান্স আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে। তখন থেকেই তাদের মূলধারার নাট্যচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কথা ভাবছিলাম। বৃটিশ কাউন্সিল এ প্রকল্পের কথা বলতেই আমি রাজি হলাম।”

বাংলাদেশের বিভিন্ন নাটকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে কটুভাবে দেখানোর দায় স্বীকার করে তিনি বললেন, “এবার সময় এসেছে, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নতুন কিছু করার।  এ নাটকটির একটি সামাজিক উদ্দেশ্যও আছে কিন্তু।  এটি শিল্পকর্ম বটে। কিন্তু এ নাটকটির মাধ্যমে শিল্পীরা  নিজেদের আত্মপরিচয়ের কথা বলবে, জানাবে নিজেদের দাবি।”

বাচ্চু জানালেন, এ নাটকে তিনি পাশ্চাত্য নাট্যরীতির সঙ্গে শেক্সপিয়রের নাট্যধারার নানা আঙ্গিকের সংমিশ্রন ঘটিয়েছেন। সেই সঙ্গে যোগ করা হয়েছে বাংলার পালাগান ও পাঁচালীর ধারা।

এই প্রকল্পের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ব্রিটিশ কাউন্সিলের হেড অব আর্টস ঈশিতা আজাদ বললেন, “প্রতিবন্ধীরা যাতে তাদের নিজেদের পরিচয় তুলে ধরে তাদের সামাজিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে পারে, একইসঙ্গে নিজেদের যোগ্যতার সমৃদ্ধি ঘটাতে পারে সে জন্য প্রতিবন্ধীদের ক্ষমতায়ন ঘটানো-এ প্রকল্পের লক্ষ্য।”   

ঈশিতা জানান, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চস্থ হবে নাটকটি। সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নাটকটির দর্শক সারিতে উপস্থিত থাকবেন নীতি-নির্ধারক, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে এমন সব সংস্থার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ।

ঢাকায় মঞ্চায়নের পর নাটকটি বিভাগীয় শহরগুলোতে মঞ্চায়নের পরিকল্পনা রয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিলের। পাশাপাশি দেশব্যাপী নাটকের পুরো ভ্রমণ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে। তারপর অভিনয়শিল্পীদের পারফরম্যান্স বিবেচনায় নাটকটির আন্তর্জাতিক সফরের সূচি নির্ধারণ করবেন ঈশিতারা।