বাজার স্থিতিশীল রাখতে এতদিন ধরে ডলার কেনার পর এখন একই উদ্দেশ্যে তা বিক্রি শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
Published : 01 Dec 2014, 10:04 PM
গত তিন দিনে সাড়ে ১১ কোটি ডলার বিক্রি করার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকায় অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, “সব সময়ই একটি মহল প্যানিক (আতঙ্ক) ছড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে।
“ডলারের দাম একটু বাড়ায় এবারও সেই কাজটি করতে চাইছে তারা। তবে বাজারে ডলারের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে।”
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, চাহিদা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। এটা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়।
সোমবার ৭৭ টাকা ৭৩ পয়সা দরে সাড়ে ৪ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নিয়ে গত তিন কার্যদিবসে বিক্রির পরিমাণ ১১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
গত কিছু দিন ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ছে। এক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকা দশমিক ৫০ শতাংশ দর হারিয়েছে।
দাম বাড়ার এই লাগাম টেনে ধরতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার ছাড়ছে বলে মনে করছেন গবেষক ও ব্যাংকাররা। তারা বলেছেন, আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়ছে দর।
সোমবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে রেকর্ড ১৮ কোটি ডলার লেনদেন হয়েছে। এর আগে কখনই মুদ্রাবাজারে এক দিনে এত বেশি ডলার লেনদেন হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক মাস আগে (৩০ অক্টোবর) টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭৭ টাকা ৪০ পয়সা। সোমবার তা বেড়ে ৭৭ টাকা ৭৩ পয়সায় উঠেছে।
ডলারের দর ‘স্থিতিশীল’ রাখতে গত তিন বছর বাজার থেকে এক হাজার কোটি ডলারের মতো কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আমদানিতে ধীর গতি এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। তখন ডলারের দাম ধরে রাখতে বাজার থেকে তা কিনতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সে কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে ডলারের দর স্থিতিশীল ছিল বলে বিশ্লেষকদের মত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে দামে।
এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই এখন বাজারে ডলার ছাড়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ছাইদুর রহমান।
তিনি সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যখন যেটা প্রয়োজন সেটাই করা হচ্ছে। এখন ডলারের দর একটু বাড়তির দিকে। সে কারণে আমরা বাজারে ডলার ছাড়ছি।
“এতদিন যেমন সরবরাহ বেশি থাকায় আমরা বাজার থেকে ডলার কিনেছি। এখন তেমনি চাহিদা বাড়ায় বিক্রি করছি। এটাই স্বাভাবিক।”
“তবে সবাইকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, বাজারে পর্যাপ্ত ডলার রয়েছে, অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই,” বলেন ছাইদুর রহমান।
আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত, যাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেখছেন তিনি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় আমদানি বাড়ছে। ব্যবসায়ী শিল্প উদ্যোক্তারা এখন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছে।
“সে কারণেই আমদানি বাড়ছে। বাড়ছে ডলারের দর। এটাই বাজারের স্বাভাবিক গতি।”
চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির জন্য প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের পদক্ষেপের মূল্যায়নে জায়েদ বখত বলেন, রপ্তানিকারক ও রেমিটারদের (যারা রেমিটেন্স পাঠান) উৎসাহ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফ্লোটিং মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ধরে রেখেছিল। ডলারের দর যাতে না পড়ে যায় সেজন্য দিনের পর দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনেছে।
“এখন প্রয়োজন পড়ছে, সেই ডলার বিক্রি করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক কাজটিই করছে,” বলেন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের এই চেয়ারম্যান।
রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলে ডলারের দাম খুব বেশি বাড়বে না বলে মনে করেন তিনি।
আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে একদিনে ১৮ কোটি ডলার লেনদেনের তথ্য ধরে ছাইদুরও বলেন, “এতেই প্রমাণিত হয় বাজারে ডলারের সরবরাহে কোনো সমস্যা নেই।”
ঈদের পর অক্টোবর মাসে রেমিটেন্স কিছুটা কমলেও নভেম্বর মাসে বেড়েছে জানিয়ে আগামী মাসগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ছাইদুর।
“সব সময়ই সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ একটু কম থাকে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের পর থেকে তা আবার বাড়তে থাকে।এবারও তেমনটাই হচ্ছে।”
গত নভেম্বর মাসে ১১৬ কোটি ডলারের রেমিটেন্স আসে, অক্টোবর মাসে এসেছিল ১০১ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও বাজার থেকে ডলার কেনা অব্যাহত রাখা হয়েছিল। সেপ্টেম্বর পর্য্যন্ত ৩০ কোটির মতো ডলার কেনা হয়।
কিন্তু কেউ বিক্রি করতে না আসায় অক্টোবরের পর থেকে আর কোনো ডলার কেনেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন উল্টো বিক্রি শুরু করেছে।
গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫১৫ কোটি ডলার কেনা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরের কেনা হয়েছিল ৪৭৯ কোটি ডলার।
২০১২ সালের প্রথম দিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এরপর থেকে তা কমতে কমতে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৮০ টাকার নিচে নেমে আসে।
২০০৩ সালে দেশে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা (ফ্লোটিং) চালু হয়। অর্থ্যাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।