বিশ্ব ব্যাংক, এডিবির মতো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের নেতৃত্বে গড়ে উঠা এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক- এআইআইবি বাংলাদেশের উন্নয়নে বড় অংশীদার হবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
Published : 12 Jan 2016, 11:47 PM
বহুল আলোচিত এই ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বেইজিংয়ের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার আগের দিন বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে বাংলাদেশ। গত সাত বছরে ৬ শতাংশের বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি আমরা। পৃথিবীর খুব কম দেশেই যেটা করতে পেরেছে।
“কিন্তু আমাদের আরও উন্নয়ন করতে হবে। নিজস্ব অর্থে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি। এমন আরও অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। সেজন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। আর তাতে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা দরকার। এআইআইবি এক্ষেত্রে আমাদের বড় অংশীদার হবে বলেই আমি প্রত্যাশা করছি।”
দুই বছরেরও বেশি সময়ের আলোচনার পর এআইআইবির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হচ্ছে ১৬ জানুয়ারি। বেইজিংয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খা ছিয়াং এর উদ্বোধন করবেন। সাংস্কৃতিক পরিবেশনাসহ দিনব্যাপী আয়োজন থাকবে অনুষ্ঠানে।
এই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে বুধবার সকালে ঢাকা ছাড়বেন অর্থমন্ত্রী। সিঙ্গাপুরে যাত্রাবিরতি করে সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ১৫ জানুয়ারি চীন যাবেন তিনি।
এআইআইবির সদস্য দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নতুন এই সংস্থার উদ্বোধনী বোর্ড অব গভর্নরস- এর সভায়ও যোগ দেবেন মুহিত।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের লক্ষ্যে গঠিত এআইআইবির তহবিল যোগানদাতা হিসেবে ৫৭টি দেশ রয়েছে; যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও কানাডা ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব বড় অর্থনীতির দেশ রয়েছে।
ব্যাংকটির মনোনীত প্রেসিডেন্ট জিন লিকুনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী মুহিত।
টানা সাত বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মুহিত বলেন, “বাংলাদেশ এক সময় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ছিল। সেখান থেকে এখন মধ্যম আয়ের দেশের গৌরব অর্জন করতে চলেছি। এটাই আমাদের সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
“কিন্তু আমরা এখানেই থেমে থাকতে চাই না। আরও অনেক দূর যেতে হবে আমাদের। এবার ক্ষমতায় এসে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, কীভাবে সরকারের কাজকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। এজন্য বাজেট বড় করা ও আরও প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি ছিল। আমরা এ কাজগুলোই করেছি।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, গত সাত বছর সরকারের অগ্রাধিকার ছিল বিদ্যুত্, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাত। একথা সত্য, এসব খাতে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে অন্য খাতগুলো কিছুটা বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে খুব বেশি বরাদ্দ দেওয়া যায়নি।
এখন এসব খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আগামীতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে আরও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। পাশাপাশি চলবে অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন।
“বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য- যা কিছু করব, তা যেন চিরস্থায়ী হয়।”
অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে মুহিত বলেন, গ্রামীণ এলাকায় রাস্তাঘাট নির্মাণ, নদী ড্রেজিংয়ের কাজ খুব ভালোভাবে চলছে।
“এখন গ্রামের এসব রাস্তা আপগ্রেড করতে হবে। আর নতুন রাস্তা বানানোর আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। শুধু আপগ্রেড (সংস্কার/উন্নতি) করা হবে। তবে আমাদের ডিস্ট্রিক্ট রোড আরও বাড়বে। হাইওয়ে আর বাড়ানো হবে না।”
অবকাঠামো উন্নয়নে এআইআইবি থেকে বিনিয়োগ পাওয়ার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “এআইআইবির বড় ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।”
বাংলাদেশ এআইআইবির সদস্য হওয়ায় বিশ্ব ব্যাংক বা এডিবির সঙ্গে সম্পর্কের কোনো অবনতি হবে কি না জানতে চাইলে মুহিত বলেন, “না তা হবে কেন? বিশ্ব ব্যাংকের বিষয়টি তো একেবারেই আলাদা। তারা সারা বিশ্বে বিনিয়োগ করে থাকে। এআইআইবি তো এশিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে।
“সে প্রেক্ষাপটে এডিবি কিছুটা বিচলিত মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এতো বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন যে, আমরা এআইআইবির সদস্য হলে এডিবি মোটেই আমাদের ওপর মন খারাপ করবে না। সে কারণে তাদের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্কের কোনো অবনতি হবে না।”
বাংলাদেশের ৮/১০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য বড় বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন- মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ফাঁদে (গ্রোথ ট্রাপ) আটকে ছিলাম। এবার সে ফাঁদ থেকে বেরিয়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাব বলে আশা করছি।
“বাংলাদেশ এখন বড় বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত। সে কারণে বিশ্ব ব্যাংক- এডিবির বাইরেও অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া গেলে সেটা আমরা সাদরে গ্রহণ করব।”
বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ-বাণিজ্য সম্পর্ক ‘বেশ ভালো’ জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের কয়েকটি বড় প্রকল্পে তারা বিনিয়োগ করছে। সে কারণে তাদের নেতৃত্বে এআইআইবির সদস্য হয়ে আমরা লাভবানই হব।”
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এআইআইবির সদস্য হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।
তারপর অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান চীন সফরে গিয়ে সমঝোতা স্মারকে সই করেন।
১০০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধিত মূলধনের (পেইড আপ ক্যাপিটাল) এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকে চীন সরকার একাই দিচ্ছে ৫০ বিলিয়ন ডলার। বাকি ৫০ বিলিয়ন ডলার যোগান দিচ্ছে অন্য ৫৬টি সদস্য দেশ।
এই ব্যাংকের সদস্য হতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশসহ ২২টি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে মুহিত জানান।
“এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সম্পদশালী দেশও রয়েছে।”
এশিয়া অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন সামিটে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক গঠনের ঘোষণা দেন।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও ইউরোপের সঙ্গে স্থলপথের সংযোগ স্থাপন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থায়ন করার মূল লক্ষ্য নিয়ে এই ব্যাংকের যাত্রা শুরু হবে বলে তখন জানিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ার অবকাঠামো খাতে এখন থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৮০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। অথচ সংস্থাটি বছরে মাত্র এক হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়ে থাকে।
মুহিত বলেন, “এ থেকেই অনুমেয় যে এডিবি, এআইআইবির মতো আরও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।”
এঅইআইবির মনোনীত প্রেসিডেন্ট জিন লিকুন গত বছরের ১৪ নভেম্বর ঢাকা সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। ব্যাংকটি প্রথম বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে বলে সে সময় জানিয়েছিলেন তিনি।