অবাক আমন্ত্রণ
এমনিতে এই সিরিজে মরনে ফন উইককে বাংলাদেশে দেখে বিস্ময় জাগা উচিত নয়। সবশেষ ম্যাচেই তো তিনি করেছেন দারুণ এক শতক। কিন্তু যেভাবে তাকে দেখা গেল, তাতে চমকে গেছেন মাঠের ভেতরে-বাইরের প্রায় সবাই। তার গায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন জার্সি নয় বরং কেতাদুরস্ত পোশাক। কিপিং গ্লাভস বা ব্যাট নয়, হাতে তার মাইক্রোফোন!
এখনও মাঠের ক্রিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোদমে। এর মধ্যেই শুরু করে দিলেন ধারাভাষ্য! কণ্ঠে বিস্ময়ের সুর শুনে হাসলেন ফন উইক, “সবচেয়ে বেশি চমকেছে দলের ছেলেরা। আমাকে এভাবে দেখে অবাক সবাই! আমি গিয়ে বললাম, ‘চলে এলাম তোমাদের সাথে থাকতে।’ অভিনন্দন জানাল সবাই।”
দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেট মৌসুম শেষ। বেশ লম্বা বিরতি। এই সিরিজে ধারাভাষ্যের সুযোগটা আসতেই তাই লুফে নিয়েছেন।
“প্রস্তাবটা পেয়ে আমি নিজেও একটু অবাক হয়েছি। তবে লুফে নিতে এক মুহূর্ত ভাবতে হয়নি। এর আগে আমি অনেক স্টুডিও ওয়ার্ক করেছি। বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়া, বিশ্লেষণ করা, এসব। তবে ধারাভাষ্য এবারই প্রথম। আমি রোমাঞ্চিত।”
আনন্দ-বেদনার কাব্য
এই সিরিজের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার সবশেষ টি-টোয়েন্টি ছিল গত জানুয়ারিতে, দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। চোটের কারণে ওই সিরিজে খেলতে পারেননি কুইন্টন ডি কক। ফেরানো হয় ফন উইককে। তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। প্রথম দুটিতে সুবিধা করতে পারেননি (১৭ ও ৪)। তবে শেষ ম্যাচে আদ্যন্ত ব্যাট করে ৭০ বলে করেন ১১৪!
সেই শতকের সুবাস এখনও প্রায় তরতাজা। তার পরও সেটি যেন কোন সুদূর অতীতের স্মৃতি! একই সঙ্গে রোমাঞ্চ আর হতাশার দোলায় কেঁপে ওঠেন ফন উইক।
“শেষ ম্যাচের শতক…দারুণ এক স্মৃতি। দেশের হয়ে শতক করতে পারা দারুণ গর্ব ও সম্মানের। আবার সুযোগ না পাওয়ায় একটু হতাশ হয়েছি। নির্বাচকেরা কুইন্টনকে ফিরিয়েছে। সে চোট পেয়েছিল বলেই আমি সুযোগ পেয়েছিলাম। কী আর করা! জীবন চলে যায়…।”
কণ্ঠে হতাশার টান স্পষ্ট। ফুটে উঠলো খানিকটা বিদ্রুপের সুরও।
পর মুহূর্তেই আবার সামলে নেন নিজেকে। ছোট্ট আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রাপ্তিগুলোতেই খুঁজে নিতে চান সান্ত্বনা।
“কোচ ও নির্বাচকদের কাজটি কঠিন। তাদের সিদ্ধান্ত আমার বিপক্ষে গেছে। আমার তাতে কি-ই বা করার আছে! নিজেকে দুর্ভাগা ভাবি না। বরং সৌভাগ্যবানই মনে করি। বিশ্বকাপ খেলেছি (২০১১ বিশ্বকাপ), কিছু রেকর্ড আছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতক করেছি, ম্যাচ-সেরা হয়েছি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ডলফিনসকে নেতৃত্ব দিচ্ছি দীর্ঘদিন। সব মিলিয়ে সময় উপভোগ করছি।”
তার ক্যারিয়ারের গল্পটাই যেন আড়ালে পড়ে থাকার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলছেন সেই ১৯৯৬ সাল থেকে। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্মও করেছেন। ভালো উইকেটকিপার, মারমুখী ব্যাটসম্যান। কিন্তু একজন মার্ক বাউচারের কারণে জাতীয় দলের দরজা আশেপাশেই থাকতে হয়েছে কেবল। বাউচার চোট-টোট পেলে এবি ডি ভিলিয়ার্স তো ছিলেনই! বাউচার অবসর নেওয়ার পরও ভাগ্য খোলেনি, টেস্টের কিপিং গ্লাভস পান ডি ভিলিয়ার্স। এর মধ্যেই দৃশ্যপটে আগমণ ডি কক নামের তরুণ প্রতিভার। সব মিলিয়ে ফন উইক আড়ালেই। সেই ২০০৩ সালে ওয়ানডে অভিষেক। কিন্তু খেলতে পেরেছেন সাকল্যে ১৪টি ওয়ানডে ও ৬টি টি-টোয়েন্টি।
নিজেকে দুর্ভাগা ভাবার তার কারণ আছে আরও। ২০০৩ সালে অভিষেক ওয়ানডেতে ১৭ রান করার পর বাদ, ৪ বছর বাইরে। ২০০৭ সালে ফিরেই প্রথম তিন ওয়ানডেতে করলেন ৫২, ৪৪ ও ৮২। পরের দুই ম্যাচে রান না পাওয়াতেই আবার বাদ। এবারও প্রায় ৪ বছরের জন্য! ২০১১ সালে ভারতের বিপক্ষে জোহানেসবার্গে টি-টোয়েন্টিতে ৩৯ বলে ৬৭ রানের ঝড়ো ইনিংস খেললেন। তার পরও আরেকটি সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে আবারও চার বছর! এবার সুযোগ পেয়ে করলেন শতক, যথারীতি আবার বাদ!
নিজের আক্ষেপের গল্পে নিজেই হেসে ওঠেন ফন উইক, “যতবার রান করি, ততবারই বাদ পড়ি। এরপর হয়ত দু-একবার রান না করে দেখতে হবে, কি হয়…!”
তবে ওই হাসি শুধুই আক্ষেপের আবরণ। ক্যারিয়ারের গল্পের একটু গভীরে ঢুকতেই সরে যায় এই তৃপ্তি কিংবা সান্ত্বনার পর্দা।
“জানি না কেন বা কিভাবে বারবার রান করেও বাদ পড়েছি। তবে কারণ যা-ই হোক, এটা খুবই দু:খজনক, ভীষণ হতাশার। প্রতিবারই বাদ পড়ার পর কিছু দিন সময় লাগে ব্যাপারটা হজম করতে। কখনো কখনো কোনোভাবেই নিজেকে বোঝানো যায় না। প্রাপ্তিগুলো থেকেই তখন সান্ত্বনা খুঁজে নিতে হয়।”
তবু মাথা নোয়াবার নয়
বয়স পেরিয়ে গেছে ৩৬। ক্যারিয়ার গোধূলিতে সম্ভাবনার প্রদীপও নিভুনিভু। ডি ভিলিয়ার্স তো আছেনই, কিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে ডি কক, ডেইন ভিলাসরা নির্বাচকদের প্রছন্দ। ব্যটিংয়েও রাইলি রুশো, ডিন এলগার, ফারহান বেহারডিনরা নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। তবু হাল ছাড়ার পাত্র নন ‘বুড়ো’ ফন উইক।
“অবশ্যই লড়ই থামাচ্ছি না। আমার গল্প এখনই শেষ নয়। আগামী ফেব্রুয়ারিতেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আমাকে ফিট থাকতে হবে, ফর্মে থাকতে হবে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকব। সুযোগ এলেই কাজে লাগাব।”
২২ গজের উত্তাপ থেকে আচমকাই ধারাভাষ্যকক্ষের শীতল আশ্রয়ে। উত্তেজনার আঁচ এখানে সরাসরি গায়ে লাগে না, তবে মাঠের উত্তেজনা তাদের কণ্ঠে পায় ভিন্ন মাত্রা। ছড়িয়ে দেন সব দর্শকের মাঝে। নতুন ভূমিকা দারুণ উপভোগ করছেন ফন উইক।
“রোববার প্রথম ম্যাচে ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় আমার অনুভূতি ছিল অভিষেক ম্যাচের মতোই! তবে এটা পুরোই ভিন্ন অভিজ্ঞতা। এমনিতে আমি সবসময়ই ক্রিকেট নিয়ে ভাবি। ক্রিকেট দেখি, বিশ্লেষণ করি। সেই ভাবনাগুলোই এখন মুখে বলছি। দারুণ উপভোগ করছি।”
এবং মাশরাফি ও বাংলাদেশ
মাঠের বাইরে থেকে এবার মাশরাফি বিন মুর্তজাকে দেখছেন ফন উইক। ধারাভাষ্যকক্ষে বসে মাশরাফিকে নিয়ে বলছেন। তবে বাংলাদেশ অধিনায়কের সঙ্গে একই দলে খেলার অভিজ্ঞতাও আছে তার। ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় আইপিএলে দুজনই খেলেছিলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে।
মাশরাফির আইপিএল অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়ার মতোই। ম্যাচের পর ম্যাচ বসে থাকতে থাকতে একটা ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন। ৪ ওভারে রান দিয়েছিলেন ৫৮। মাশরাফির শেষ ওভারে ২৬ রান নিয়ে ডেকান চার্জার্সকে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছিলেন রোহিত শর্মা। মাঠের বাইরেও নানা অবহেলার শিকার হয়েছিলেন। তবে এতকিছুর মাঝেও মাশরাফি তার ভেতরের আলো ঠিকই ছড়াতে পেরেছিলেন। সেই আলোর বিচ্ছুরণ এতদিন পরও চোখে লেগে আছে ফন উইকের।
“আমার মনে পড়ে মাশরাফি তখন থেকেই মানুষ ও নেতা হিসেবে ছিল একাগ্র ও দারুণ সম্পৃক্ত। ওর নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ভালো করতে দেখে আমি একটুও অবাক হইনি। কারণ মাশরাফি সহজাত নেতা। সবার সেরাটা বের করে আনতে পারে সে। ওর কথা সবাই শোনে। ওর সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল দারুণ। সবসময়ই শতভাগ উজাড় করে দেয়।”
ফন উইক মুগ্ধ বাংলাদেশেও, “এই নিয়ে তিনবার বাংলাদেশে এলাম। প্রতিবারই দারুণ উপভোগ করেছি। ক্রিকেট নিয়ে এখানকার মানুষের আবেগ মুগ্ধ করার মতোই।”