যে কারণে খারিজ হয় কামারুজ্জামানের রিভিউ

আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে ‘ত্রুটি না পাওয়ায়’ যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যায়; শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতেই ঝুলতে হয় এই জামায়াত নেতাকে। 

মহিউদ্দিন ফারুকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2015, 09:56 PM
Updated : 11 April 2015, 09:56 PM

গত ৬ এপ্রিল ওই রায় ঘোষণার দুই দিন পর তা কারাগারে পৌঁছায়। সব অনুষ্ঠানিকতা শেষে শনিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয় কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড।   

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ গতবছর ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। কামারুজ্জামানের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনও খারিজ করে একই বেঞ্চ।

এই বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

৩৬ পৃষ্ঠার এ রায়টি লিখেছেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। অন্যরা তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।

তিন সাক্ষীর বক্তব্য

রিভিউ শুনানিতে কামারুজ্জামানের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ জন পুরুষকে হত্যার অভিযোগে তিনজন সাক্ষীর জবানবন্দিতে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও ‘তারা কেউ প্রত্যক্ষদর্শী নন’। তাদের তিনজনের বক্তব্যেও ‘গরমিল’ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়, আসামিপক্ষের আইনজীবী প্রসিকিউশনের তিন সাক্ষীর বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নতুন কিছু নয়। আপিলের শুনানিতে তা বিস্তারিত পরীক্ষা করা হয়েছে, পুনর্বিবেচনায় তাতে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল মানবতাবিরোধী অপরাধীকে ‘ক্ষমা করেছিলেন’ বলে আসামিপক্ষের আইনজীবী শুনানিতে যে যুক্তি দিয়েছেন- তা ‘সত্য নয়’ বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, “প্রকৃতপক্ষে যারা কোনো ফৌজদারী অপরাধে যুক্ত ছিলেন না শুধুমাত্র তাদেরকেই বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু যারা স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ফৌজদারী অপরাধে যুক্ত ছিলেন তাদের বিষয়ে অবশ্যই এমন কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। বরং তাকে (বঙ্গবন্ধু) কাপুরুষোচিতভাবে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষীদের বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করেছে।”

‘মৃত্যুদণ্ড রদ’ প্রসঙ্গ

শুনানিতে একটি যুক্তিতে আসামির আইনজীবী বলেছিলেন, নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়াল ছাড়া বিশ্বে আর যে পাঁচটি যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে তাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল না। আন্তর্জাতিকভাবে যেখানে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কমিয়ে আনা হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশেও বিষয়টি বিবেচনা করা যায়।

রায়ে বলা হয়, “এটা সত্যি যে অনেক দেশ সর্বোচ্চ শাস্তি রদ করার বিষয়ে একত্রিত হয়েছে, এটিও সমান সত্যি যে ৫৫টি দেশ এখনও সর্বোচ্চ শাস্তি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত বজায় রেখেছে এবং এর মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি প্রদেশের মধ্যে ৩২টি।

“অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০১৪ সালে পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ এর বেশি। এর আগের বছর পর্যন্ত অন্তত ২ হাজার ৪৬৬ জনকে সারা পৃথিবীতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্তের অধিকার

রায়ে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্তের অধিকারের বিষয়টি এখন সর্বজন স্বীকৃত। মনে করা হয়, অপরাধীকে সাজা দেয়ার সময় কেবল অপরাধীর মৌলিক অধিকারকে আবদ্ধ না করে ক্ষতিগ্রস্তের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা ও অধিকারের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

“আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে নৃশংসতার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আসামিকে অনুকম্পা দেখানো হলে আক্ষরিকভাবেই সেটি হবে এমন একজন স্বাধীনতাবিরোধীকে জীবন দেওয়া, যার হাতে সমগ্র জনসাধারণ নৃশংসতার স্বীকার।”  

‘নতুন দলিল’ টেকেনি

রিভিউ শুনানিতে আসামিপক্ষ ফরিদা আক্তার সম্পাদিত 'মহিলা মুক্তযোদ্ধা’ বইয়ে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকার আদালতে দাখিল করে। খন্দকার মাহবুব বলেন, সেখানে ঘটনার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে দায়ী করা হয়েছে, কামারুজ্জামানকে নয়।

রায়ে বলা হয়, “শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বইটি পড়ার পর আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি যে, এটি এমনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের রক্ষায় ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।”

‘ত্রুটি নেই’

কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদনের রায়ে বলা হয়, কোনো ফৌজদারী মামলার রায় রিভিউ হতে পারে নথিতে (রেকর্ড) ত্রুটি থাকলে।

“রিভিউ আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে কোনো ত্রুটি ধরা পরেনি। পিটিশনটি খারিজ করা হলো।”