ওই গুজব থেকেই ঘাটমুখী রাস্তায় অতিরিক্ত মানুষের হুড়োহুড়ি শুরু হলে ১০ জনের মৃত্যু হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
শুক্রবার সকালের এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। হতাহতের জন্য অব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করেছেন কেউ কেউ।
চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টম তিথিতে ভোররাত ৫টা ২৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যস্নানের সূচনা হয়।
দেশ-বিদেশের প্রায় ১৫ লাখ পুণ্যার্থীর স্নানের জন্য লাঙ্গলবন্দের তিন কিলোমিটার এলাকায় প্রস্তুত করা হয় ১৬টি ঘাট।
তবে স্নানের জন্য সবচেয়ে প্রাচীন রাজঘাটই প্রতিবছর পুণ্যার্থীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে। ওই ঘাটে স্নান করলে বেশি পুণ্য পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করেন তারা।
ঘাটের ৫০ গজের মতো দূরে রয়েছে একটি বেইলি ব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়ে একটি মোড়, যেখানে তিন দিক থেকে আসা পুণ্যার্থীরা মিলিত হয়ে রাজঘাটের দিকে যেতে পারেন।
সকাল পৌনে ৮টার দিকে হঠাৎ ব্রিজ ভেঙে পড়ার গুজব ছড়িয়ে পড়লে রাস্তাভর্তি মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয় বলে ওই মোড়ের এক দোকানি জানান।
‘ভাই ভাই স্টোরের’ মালিক শাহাবুদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছু বোঝার আগেই হুড়োহুড়ি শুরু হয়। ব্রিজ ভেঙে পড়ার কথা বলতে বলতে অনেকে এসে আমাদের দোকানে পড়ে। আমার ও এক কর্মচারীর উপরেও পড়ে অনেকে।”
ওই এলাকার বাসিন্দা গাড়িচালক আলী নূরও ব্রিজ ভাঙার গুজব ছড়িয়ে হুড়োহুড়ির কথা বলেন।
ঘটনার সময় রাজঘাটে স্নান সেরে বেইলি ব্রিজের দিকে আসছিলেন তিন বোন ছবি রানী, রিনা রানী ও স্বপ্না রানী দাশ।
ছবি ও রিনা জানান, তারা তিন বোন একসঙ্গে হাঁটতে থাকলেও হঠাৎ বুঝতে পারেন স্বপ্না তাদের সঙ্গে নেই। হঠাৎ ব্রিজ ভেঙে পড়ার কথা শোনা যায়; সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে হুড়োহুড়ি। ব্রিজের দিক থেকে মানুষের ধাক্কা আসতে থাকে।
পরে তিন রাস্তার মোড়ে স্বপ্নাকে পান জানিয়ে ছবি বলেন, দুই থেকে তিন জনের ওপর স্বপ্না পড়েছিল। তার ওপরও কয়েকজন ছিল।
ওই মোড়ের অন্য দুই দোকান ‘সলেমুননেসা ওষুধ ঘর’ ও ‘রনি কনফেকশনারি’র কর্মচারীরাও ব্রিজ ভাঙার গুজবের কথা জানান। তবে ওই গুজবের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে সে বিষয়ে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
এই ঘটনায় নিহত ভগবতি (৪০) ও তার মেয়ে রাহীর স্বজন কিষাণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকার জিগাতলা থেকে পুণ্যস্নানের জন্য এসেছিলেন তার পিসি ও পিসতুতো বোন। রাজঘাটে স্নানে ‘পুণ্য বেশি’ বলে তারা ওখানে যান।
দুপুরে ওই এলাকায় গিয়েও প্রচুর মানুষের ভিড় দেখা যায়। বেইলি ব্রিজ পেরিয়ে একপাশ দিয়ে ঘাটের দিকে যেতে দেখা যায় পুণ্যার্থীদের, অন্যপাশ দিয়ে আসছিলেন ঘাটফেরতরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এ সময় তদারক করতে দেখা যায়।
তবে সকালে পুলিশের ওই তদারকি ছিল না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। স্নান শুরু থেকে এ ধরনের তদারকি থাকলে প্রাণহানির ঘটনা এড়ানো যেত বলে মনে করেন তারা।
প্রতিবছরই লাঙ্গলবন্দে পুণ্যস্নান উৎসব হয়। পাপমোচনের জন্য নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্রের তীরে আসেন দেশ-বিদেশের লাখো পুণ্যার্থী।
তবে কীভাবে ও ঠিক কখন থেকে লাঙ্গলবন্দে পুণ্যার্থীদের আগমনের সূচনা সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
প্রচলিত কাহিনী মতে, জমদগ্নী নামের এক মুনি পিতৃভক্তি পরীক্ষার জন্য তার চার ছেলেকে তাদের মা রেনুকাকে হত্যার আদেশ দেন। অন্যরা তা প্রত্যাখ্যান করলেও ছোট ছেলে পরশুরাম কুঠার দিয়ে মাকে দ্বিখণ্ডিত করেন।
“এরপর পরশুরাম তার কুঠার লাঙ্গলবদ্ধ করে পর্বতের মধ্য দিয়ে চালাতে থাকেন। সেই লাঙ্গলের ফলায় তৈরি পথ ধরে সৃষ্টি হয় ব্রহ্মপুত্র নদের। ওই পথ ধরে চলতে থাকেন পরশুরাম নিজেও। এভাবে অনেক দিন পর নারায়ণগঞ্জের বর্তমান স্নানঘাটে এসে লাঙ্গলটি আটকে যায়। হিমালয় থেকে বয়ে আসা ব্রহ্মপুত্রের পানিতে ওই স্থানে স্নান করে পাপমুক্তি ঘটে পরশুরামের। খসে পড়ে হাতের কুঠার। অর্থাৎ পরশুরামের লাঙ্গলের ফলা থেমে যাওয়া বা বন্ধ হওয়া থেকেই এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্ধ।”
সেই লাঙ্গলবন্ধই সময়ের বিবর্তনে উচ্চারণের পরিবর্তনে আজকের লাঙ্গলবন্দ নামে পরিচিতি পায় বলে পুরোহিতরা জানিয়েছেন।