জাতির জনকের জন্মদিনে নানা কর্মসূচি

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী মঙ্গলবার। দিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসাবে পালিত হবে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2015, 07:05 PM
Updated : 16 March 2015, 07:05 PM

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।

মঙ্গলবার সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে। এর আগেই সকাল সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, শিশু সমাবেশ, আলোচনা সভা এবং গ্রন্থমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর অবদান স্মরণ করে এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি এক অনন্যসাধারণ ইতিহাস। তিনি নিজ গুণ ও কর্মে পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে সমাজ, দেশ ও সমকালীন বিশ্বে চির ভাস্বর হয়ে আছেন। তিনি কেবল বাঙালির নন, বিশ্বে নিপীড়িত-শোষিত মানুষের স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তির দূত।”

আলাদা বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা বলেন, “জাতির পিতা শুধু বাঙালি জাতিরই নয়, তিনি ছিলেন বিশ্বের সকল নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় ও মুক্তির অগ্রনায়ক।”

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের প্রচলিত আদালতে বিচার ও রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালি কিছুটা হলেও দায়মুক্ত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত অবশিষ্ট পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

“স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে আমরা বদ্ধপরিকর,” বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ছাত্রলীগ দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ও টুঙ্গীপাড়ায় সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে মিলাদ ও আলোচনা সভা হবে।

যুবলীগও নিজেদের কার্যালয়ে দলীয় ও জাতির পতাকা উত্তোলন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। এছাড়াও এই যুব সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা টুঙ্গীপাড়ার কর্মসূচিতে অংশ নেবেন।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে মঙ্গলবার সকাল পৌনে ৮টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বহির্বিভাগে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবার উদ্বোধন করা হবে।

টুঙ্গিপাড়ায় এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কৈশোরে তার রাজনীতির দীক্ষাগুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন শেখ মুজিব।

ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন শেখ মুজিব।

ওই সময় থেকেই নিজেকে ছাত্র-যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন, যোগ দেন আওয়ামী মুসলিম লীগে, যা পরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগ নাম নেয়।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট পালনকালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত তিনি বারবার কারারুদ্ধ হন।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন জনগণের দাবি আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব।

বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বারবার কারাগারে যেতে হতে হয়েছে শেখ মুজিবকে। আর আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাকে নিয়ে যায় বাঙালির নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ-প্রধান হিসেবে ’৬৬-এ ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি, যার পরে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে।

’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি।

এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ দেন। ’৭১-এর মার্চে শুরু করেন অসহযোগ আন্দোলন।

৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে তার ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাঙালিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে ধাবিত করে।

’৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করার পর সে রাতেই বন্দি হন শেখ মুজিব। তবে তার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকলেও তার নামেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতিও ছিলেন তিনি।

অন্যদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা ও বিদ্রোহের অভিযোগ এনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে গোপন বিচারের নামে প্রহসন শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর  বিরুদ্ধে।

নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আসে। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন ভূমিতে পা রাখেন।

সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দায়িত্বভার নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যদিও ওই সময়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন, গঠন করেন বাকশাল; যার ফলে দেশে অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়, চারটি সংবাদপত্র ছাড়া অন্য সব সংবাদপত্রও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

তার কিছু দিনের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এক দল সেনা কর্মকর্তার হাতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু।

যে দেশের স্বাধীনতার জন্য রাজপথ কিংবা কারাগারে যার জীবন কেটেছে, সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে অবসান ঘটে স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কের; এবং তা বাঙালিরই হাতে।