৭ মার্চের সেই ভাষণ এখনও নতুন, এখনও প্রেরণার: হাসিনা

একাত্তরে অগ্নিঝরা মার্চে যে ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক এসেছিল, স্বাধীনতার পঞ্চম দশকে এসে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন শেখ হাসিনা এখনও প্রেরণা নেন বাবার সেই ভাষণ থেকে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2015, 02:50 PM
Updated : 15 March 2015, 03:24 PM

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতীয় মুক্তির ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি বাংলাদেশ গঠনে তরুণ প্রজন্মের কাছে এখনও দিক-নির্দেশনা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

“আজকে ৪৪ বছর পরেও এই ভাষণটি যখন বাজানো হয়, আমরা যখন শুনি; তখন মনে হয়, যেন নতুন করে শুনছি,” রোববার এক অনুষ্ঠানে বলেন শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত বলেও মনে করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। 

“৪৪ বছর ধরে এই ভাষণটি কত কোটি কোটি বার যে বাজানো হয়েছে, কত কোটি কোটি বার যে মানুষ শুনেছে, বোধ হয় এর কোনও হিসাব কেউ কখনও দিতে পারবে না। কত ঘণ্টা, কত দিন, কত মাস, কত বছর, কেউ বলতে পারবে না।”

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আসা শেখ হাসিনা বলেন, “সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেরণা এখনও শেষ হয়নি। আগামী দিনের নেতৃত্বে যারা আসবে, এই ভাষণ তাদের দিক-নির্দেশনা দেবে।”

“বাঙালি জাতির জন্য এই ভাষণ নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেবে, সাহস দেবে, যে কোনো ধরনের বাধা আসুক না কেন- তা অতিক্রম করে বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবার শক্তি ও সাহস জোগাবে।”

স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারে রয়েছেন।

“আমাদের সংগ্রাম এখনও তো শেষ হয়নি। এখনও সেই জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড, মানুষ পুড়িয়ে মারা, মানুষকে হত্যা করা, মানুষের ওপর এখনও নানাভাবে জুলুম চলছে।”

“আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদেরকে প্রেরণা দেবেন জাতির পিতা,” বলেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “যে কোনো শক্তি, যারা আমাদের দেশের মানুষের অধিকার কেড়ে নিতে চায় যে কোনো শক্তি, যারা আমাদের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায়। যারা এদেশের মানুষের সব অধিকার পদদলিত করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এটাই সময়। আর সাতই মার্চের ভাষণই দেবে সেই প্রেরণা।

“এই ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য মনে হয় নতুনভাবে প্রেরণা দেয়, নতুনভাবে মানুষকে উজ্জীবিত করে।”

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ নিয়ে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ আয়োজিত আলোচনা সভায় একাত্তরের ৭ মার্চের দিনটিও স্মরণে আনেন শেখ হাসিনা।

“এই ভাষণটি যখন বঙ্গবন্ধু দিতে যাবেন, তখন অনেকে অনেক কথা বলেছেন, অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। তিনি পর্দার আড়ালেই ছিলেন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক চিন্তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

বাঙালির ইতিহাসের বাঁক বদলের সেই ভাষণের নেপথ্যে নিজের মায়ের যে ভূমিকা ছিল, তাও উঠে আসে শেখ হাসিনার কথায়।   

“এই ভাষণটি যখন আমার বাবা দিতে যাবেন, তখন অনেক লেখা, অনেক পরামর্শ নিয়ে সবাই হাজির। যখনই বঙ্গবন্ধু কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিতে যেতেন, তখন তিনি (বেগম মুজিব) একটা কাজ করতেন- সকলের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে কিছুক্ষণের জন্য আড়াল করে দিতেন।”

“মা আব্বাকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন, আমিও সেখানে। বললেন, ‘তুমি এখানে অন্তত ১৫টা মিনিট চুপ করে শুয়ে থাক’। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মা পাশে মোড়াটা টেনে নিয়ে বসলেন।”

“বললেন, ‘আমি একটা কথা বলতে চাই। আজকে, তোমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। লাখো মানুষ তোমার সামনে। এই মানুষের ভাগ্য তোমার হাতে। অনেকে অনেক পরামর্শ দেবে, অনেকে অনেক কথা বলবে। কিন্তু, তোমার মন যে কথা বলবে, তুমি ঠিক সেই কথাটাই তোমার ভাষণে বলবে। অন্য কোনো কথা বলবে না। আর, তুমি যা বলবে- বাঙালীর জন্য সেটাই সঠিক হবে’।সেটাই হয়েছিল।”

১৯৭৫ সালে ১৫ অগাস্টের পর সামরিক সরকার আমলে এই ভাষণের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকার কথাও বলেন শেখ হাসিনা।

“পঁচাত্তরের পর এই ভাষণটা নিষিদ্ধ ছিল বাংলাদেশে, কী দুর্ভাগ্য আমাদের! এই ভাষণ বাজানো যেত না।”

১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ২১ বছর এই ভাষণটি বাজাতে গিয়ে বার বার বাধা পাওয়ার কথাও বলেন তিনি।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ- বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ’ এবং গোলাম মাওলা প্রকাশিত ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’ গ্রন্থ দুটির মোড়ক উন্মোচন করেন।

৭ মার্চের ভাষণের ওপর ২০০৪ সাল থেকে বিভিন্ন সেমিনারে পাঠ করা মূল প্রবন্ধ গ্রন্থিত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ-বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ’ এ।

পোয়েট অফ পলিটিক্স গ্রন্থে ১২টি ভাষায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সঙ্কলিত হচ্ছে। দ্বিতীয় সংস্করণে আরও ১৮টি ভাষায় প্রকাশিত এই ভাষণটি সঙ্কলন হবে বলে জানানো হয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন ও সাংবাদিক বেবী মওদুদকে স্মরণ করে বলেন, “আমরা ২০০৪ সাল থেকে এই অনুষ্ঠানগুলো করে যাচ্ছি। ২০০৪ সাল থেকে আমরা ভাষণগুলো সংরক্ষণ করে যাচ্ছি। ভাষণগুলো প্রকাশ করা হবে। আজকে সেই দিনটি আমাদের এল। কিন্তু, আজ আর তারা আমাদের মাঝে নেই।

“আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী নিয়ে। যেখানে প্রফেসর সালাহউদ্দীন সাহেব আমাদের সব সময় পরামর্শ দিতেন। একে একে সবাই চলে গেছে।”

অনুষ্ঠানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশীদ  ‘বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ- কেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাত মার্চের পুরো ভাষণের ভিডিও প্রদর্শন করা হয়।

অনুষ্ঠানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক শাহিনুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, ‘পোয়েট অফ পলিটিকস’ গ্রন্থের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সংসদ সদস্য নাজমুল আহসান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান বক্তব্য রাখেন।