অভিনেতা খলিলের জীবনাবসান

পাঁচ দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অভিযাত্রার সঙ্গে থেকে চিরবিদায় নিলেন অভিনেতা খলিল উল্লাহ খান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2014, 06:22 AM
Updated : 7 Dec 2014, 03:13 PM

রোববার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে গুণী এই শিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

৫৪ বছর ধরে প্রায় আটশ’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন খলিল, তবে এর শুরুটা হয়েছিল টিভি নাটকের মধ্য দিয়ে।

গত কয়েক বছর ধরেই ফুসফুস, লিভার ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন অভিনেতা খলিল। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কয়েকবার হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়েছিল বলে জানান তার ছেলে মুসা খান।

খলিলের মৃত্যুর খবরে দেশের চলচ্চিত্রসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। অভিনয় জগতের অনেকেই স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস উইং থেকে ফেইসবুক পেইজে তাৎক্ষণিকভাবে শোক জানানো হয়। গত ১০ মে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অসুস্থ অভিনেতা খলিলের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

খলিলকে আজীবন সম্মাননা তুলে দিচ্ছেন শেখ হাসিনা

তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “তার আজীবন চিকিৎসার দায়িত্ব আমি নিলাম। তিনি আমাদের অনেক দিয়েছেন। এখন তাকে দেওয়ার পালা।”

অভিনেতা খলিলের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিবৃতি দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও।

হাসপাতাল থেকে প্রথমে খলিলের মরদেহ মোহাম্মদপুরের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বিকালে কফিন নিয়ে যাওয়া হয় এফডিসিতে।

সেখানে জানাজা শেষে খলিলের মরদেহ আবার বাসায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এশার নামাজের পর আরেকবার জানাজা শেষে নূরজাহান রোডে মোহাম্মদপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

এফডিসির জহির রায়হান কালার ল্যাব চত্বরে খলিলের কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানান তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও উপস্থিত হন সেখানে।

মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ জাতশিল্পী। রাষ্ট্র থেকে যে ধরনের সহযোগিতা ও সম্মান তাকে দেওয়া প্রয়োজন ছিল, আমরা সেই সম্মানটুকু তাকে দিতে পেরেছি।”

তরুণ প্রজন্মের জন্য খলিল অভিনীত চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নাটকগুলো আর্কাইভ আকারে সংরক্ষণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আহ্বানও জানান তিনি।

মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত পরিবার

তথ্যমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

রূপালি পর্দায় যাকে প্রায় সময়ই প্রতিপক্ষে দেখতে হয়েছে, সেই খলিলের মৃত্যুর খবর শুনে এফডিসিতে ছুটে আসেন ‘নায়করাজ’ রাজ্জাকও।   

“তার মতো মানুষ আমি দেখিনি। সাহসী খলিল কখনও মিথ্যাকে ভয় পেতেন না। আপাত দৃষ্টিতে গম্ভীর মনে হলেও আসলে তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন,” সহকর্মীকে স্মরণ করেন তিনি।

অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, বাঁদী থেকে বেগমসহ বেশ কটি চলচ্চিত্রে খলিলের সহঅভিনেত্রী ববিতা বলেন, “তিনি আমার এত প্রিয়, এত আপনার মানুষ ছিলেন- তার সঙ্গে ছিল আমার আত্মার সম্পর্ক। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি আমাকে প্রায়ই ফোন করতেন। তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি যেগুলো আসলে বলে শেষ করা যাবে না।”

খলিলের আরেক সহঅভিনেতা চিত্রনায়ক আলমগীর কোনো স্মৃতিচারণে না গিয়ে বলেন, “যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে তা কেউ কোনোদিন পূরণ করতে পারবে না।”

প্রবীণ অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, “তিনি যখন যে চরিত্রে অভিনয় করতেন। সেগুলোকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতেন যে মনে হতো এই চরিত্রগুলো তার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। শিল্পী কখনও তৈরি হয় না। খলিল শিল্পী হিসেবেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন।”

মরদেহের সামনে এসে শোকাভিভূত খলিলের সহকর্মী আমজাদ হোসেন ও এটিএম শামসুজ্জামান

জানাজায় তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অভিনেতা রাজ্জাক, আলমগীরসহ খলিলের সহকর্মীরা

অভিনেতা পরিচালক আমজাদ হোসেনের একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন খলিল। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে আমজাদ হোসেন এই অভিনেতার সম্পর্কে বলেন, “তার সঙ্গে আমার ছিল পিতা-পুত্রের সম্পর্ক । আমাদের প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন বটগাছের মতো।”

বিএফডিসি শিল্পী সমিতির সাবেক সভাপতি খলিলের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মিশা সওদাগর বলেন, বিএফডিসিতে শিল্পীদের বসার কোনো জায়গা ছিল না। সিনিয়র অভিনেতা হিসেবে তিনি বিএফডিসিতে শিল্পী সমিতির কার্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

১৯৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেটের কুমারপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন খলিল উল্লাহ খান। এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫১ সালে যোগ দেন আনসারে। 

১৯৫৯ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘সোনার কাজল’ এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে খলিলের সিনেমায় পদার্পণ।

তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘প্রীত না জানে রীত’, ‘সংগম’, ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’, ‘ক্যায়সে কঁহু’, ‘জংলি ফুল’, ‘আগুন’, ‘পাগলা রাজা’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘ওয়াদা’ , ‘বিনি সুতার মালা’, ‘বউ কথা কও’, ‘কাজল’।

১৯৬৬ সালে এস এম পারভেজ পরিচালিত ‘বেগানা’ সিনেমায় প্রথমবারের মতো খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এরপর বহু সিনেমায় তাকে খলচরিত্রে দেখা গেছে। ইতিহাসনির্ভর ‘ফকির মজনু শাহ’ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেও তিনি ভূয়সী প্রশংসা পান।

১৯৬৫ সালে ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে খলিল আত্মপ্রকাশ করেন পরিচালক হিসেবে। ‘সিপাহী’ ও ‘এই ঘর এই সংসার’ নামে দুটি সিনেমার প্রযোজনাও করেছেন তিনি।

সংশপ্তক নাটকের একটি দৃশ্যে হুমায়ুন ফরিদী ও খলিল, দুজনই আজ প্রয়াত

বহু টিভি নাটকে অভিনয়ের জন্যও দর্শক খলিলকে মনে রাখবে বহুদিন।

শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ধারাবাহিক নাটক সংশপ্তকে তার অভিনয়ে ‘মিয়ার বেটা’ চরিত্র দর্শকনন্দিত হয়। ‘টাকা আমার চাই, নইলে জমি’ ফেলু মিয়ার (মিয়ার বেটা) এই সংলাপ তখন ছিল ব্যাপক আলোচিত।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক সভাপতি খলিলকে ২০১২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়।