‘চোখ হারালেও শান্তি পাই নেত্রী বেঁচে থাকায়’

প্রতিবাদী সমাবেশে গ্রেনেডের ছোবলে ২৪ জনের প্রাণহানিতেই শেষ হয়নি ক্ষতি; বোমার স্প্লিন্টারে কেউ হারিয়েছেন চোখ, কারো গেছে চলার ক্ষমতা, কারো সারা জীবনের সঙ্গী হয়েছে যন্ত্রণা।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2014, 07:46 PM
Updated : 21 August 2014, 04:41 AM

ক্ষত নিয়ে এক দশক পার করলেও তাদের অনেকের সান্ত্বনা নেত্রীর বেঁচে থাকা। ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তি সবার প্রথম চাওয়া।

২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আহত কয়েকজন এভাবেই প্রকাশ করেন তাদের বর্তমান অবস্থা।

ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন আরো প্রায় পাঁচশ নেতাকর্মী।

হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার পর বাঁ কিডনি বদলে ফেলতে হয় রত্না আক্তার রুবির। এখনো তার দুই পা, দুই হাত ও শরীরের বিভিন্ন অংশে রয়েছে স্প্লিন্টার।

স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সারা শরীরে স্প্লিন্টার থাকায় এখনো প্রচণ্ড ব্যথা হয়। গরমে থাকলে শরীরের বিভিন্ন অংশ চুলকায়। অল্প কাজ করলেই হয়রান হয়ে যাই। শরীরের কোন অংশে সামান্য চাপ দিলেই ফুলে যায়।”

একমাত্র ছেলে নিলয়ের জন্য পছন্দের খাবার রান্না করে দিতে না পারায় আফসোস করেন রত্না।

“বাচ্চার জন্য ভাল-মন্দ কিছু রান্না করতে চুলার পাশে গেলে শরীর কাঁপে। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারি না ভেবে প্রচণ্ড কষ্ট হয়,” বলেন তিনি।

বাগেরহাটের মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলীর মেয়ে রত্না বলেন, “চিকিৎসার জন্য বাবা কারো কাছে হাত পাততে দেন না। তবু কিডনি বদলানোর সময় দল থেকে দুই লাখ টাকা পাইছিলাম। সেইটা দিয়া ভারতে চিকিৎসা নিছি।”

একই ঘটনায় বাঁ চোখ হারান মিরপুরের বাসিন্দা আওয়ামী লীগ কর্মী দেলোয়ার হোসেন। উত্তরার আমেনা গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপকের গাড়ি চালান তিনি।

বিস্ফোরণে তার চোখে মুখে স্প্লিন্টার লাগে জানিয়ে তিনি বলেন, “তখন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি।

“ছোটবেলায় বাপ-মাকে হারিয়েছি। এরপর জীবনের একটা সময়ে হারালাম নিজের চোখ। আমার খুব কষ্ট হয় জীবন চালাতে। কিন্তু এইটা ভাবলে সুখ হয় যে, নেত্রী তো বাঁইচা আছে। দেশটা ভাল থাকলে আমরা সবাই তো ভাল থাকুম।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরোনো ভবনের ৪৫ নম্বর কেবিনে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন শেরপুরের নকলা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ উম্মে কুসুম রেনু।

প্রতি ছয় মাস পরপর এই হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে হয় তাকে।

তিনি বলেন, “একুশে অগাস্টের গ্রেনেড হামলার সময় নেত্রীর ট্রাকের কাছেই ছিলাম। হঠাৎ একটা বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়েছিল। এরপর আমার জ্ঞান ছিল না টানা ১৪ দিন। স্মৃতিশক্তি ছিল না প্রায় ছয় মাস।”

চিকিৎসার জন্য যেদিন তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেদিনই জ্ঞান ফেরে বলে জানান তিনি।

বাঁ চোখ, মাথা ও পাসহ শরীরে বিভিন্ন অংশ স্প্লিন্টার ঢুকে যায় জানিয়ে রেনু বলেন, “ওগুলো রক্তের সঙ্গে মিলে গেছে। শরীর থেকে বের করা যায় না।

“প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনছি। প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই আমরা।”

ওই দিন হাজারীবাগ থেকে ১৮ জন নারীর মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন যুব মহিলা লীগের হাজারীবাগ থানার যুগ্ম সম্পাদক নীলুফা রহমান।

“আমাদের এলাকায় ওই সময় নাসিরুদ্দিন পিন্টু এমপি ছিল। কাউকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে দিতো না। তারপরও সব কিছু তুচ্ছ করে আমি দলের কর্মসূচিতে গিয়েছিলাম।”

মিছিলে তার সঙ্গীদের মধ্যে রিজিয়া বেগম ও সুফিয়া আক্তার হামলা দিনই মারা যান। গুরুতর আহত হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।

নিজের বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনায় এই আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, “বোমার স্প্লিন্টার শরীরে ছোট ছোট শস্য দানার মতো শক্ত হয়ে আছে। অপারেশন করার অবস্থা নাই।”

“তিলে তিলে মারা যাচ্ছি ভাই। জীবনের অনেক স্বাদ-আহ্লাদ এখন আর চাইলেও পূরণ করতে পারি না। বাচ্চারা মায়ের হাতের রান্না খেতে চায়। কিন্তু রান্না ঘরে যেতে কষ্ট হয়। ওরা আমাকে বকা দেয়, রাগ করে; কিন্তু আমি নিরুপায়,” কাঁদতে কাঁদতে বলেন তিনি।    

লাশের গাড়িতে নড়েচড়ে না উঠলে আর কোন দিন পৃথিবীর আলো বাতাস দেখা হতো না আওয়ামী লীগ নেত্রী নাসিমা ফেরদৌসীর।

শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

এর মধ্যেই সংরক্ষিত মহিলা আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। 

নাসিমার জন্ম বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায়। তার বাবার নাম হাজী জালাল উদ্দিন। আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসেবে ছোট বেলা থেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন নাসিমা।

বিয়ের পরে ব্যবসায়ী স্বামী হারুন অর রশিদের সঙ্গে ঢাকা চলে আসেন। ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে দলীয় কর্মকাণ্ড শুরু করেন।

২১ অগাস্টের হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা ট্রাকে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বক্তব্য শেষ হবার আগেই গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। কোথাও যাবার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল যেন, চারিদিকে আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে। এরই মধ্যে টের পাই, শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখি, সকলেরই একই অবস্থা।”

এরপর কোন এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অজ্ঞান অবস্থায় তাকেও তোলা হয়েছিল লাশের ট্রাকে। কিন্তু নড়েচড়ে ওঠার পরে পুলিশ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

নাসিমা বলেন, হাসপাতালের করিডোরে পড়ে ছিলেন। একজন এসে তার কাছে আত্মীয়-স্বজনের মোবাইল নম্বর চায়। ছেলের নম্বর দেয়ার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ করে।

“ধানমন্ডি থেকে ছেলের আসতে বেশ দেরি হয়। ততক্ষণে শরীরের রক্ত অর্ধেক বের হয়ে গেছে। চিকিৎকরা জানালেন, আমাকে বাঁচাতে হলে কমপক্ষে ১০ ব্যাগ রক্ত লাগবে।

“বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ঘুরে ছেলে রক্তদাতাদের নিয়ে আসলো। রাতে কয়েক ব্যাগ রক্ত দেয়া হলো। পরের দিন সকালে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে অপারেশন করে আমার শরীর থেকে কিছু স্প্লিন্টার বের করা হলো।”

এর কিছুদিন পর পায়ে পচন ধরে যায় জানিয়ে নাসিমা বলেন, তখন আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে দলীয় খরচে দিল্লির অ্যাপেলো হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে আড়াই মাস পরে দেশে ফিরে আসেন। প্রাণে বেঁচে গেলেও চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান তিনি।

এতো যন্ত্রণা, এতো অশান্তির মাঝেও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের কয়েকজনের ফাঁসি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ায় সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন বলে জানান নাসিমা।

“তবে জীবনের সবচেয়ে বড় আশা, ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলাকারীদের ফাঁসি দেখে মরতে চাই,” বলেন তিনি।

(বরগুনা প্রতিনিধি মনির হোসেন কামাল প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন।)