গ্রেনেড হামলার ১০ বছর

বিভীষিকাময় গ্রেনেড হামলার ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে বৃহস্পতিবার, ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে ওই হামলায় নিহত হয়েছিলেন আইভি রহমানসহ ২৪ জন।

সুমন মাহবুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2014, 03:31 PM
Updated : 20 August 2014, 07:43 PM

“মনে হচ্ছিল যেন চারিদিকে আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে, শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল,” সেই হামলার ধরন কেমন ছিল, তা স্পষ্ট হয় বেঁচে যাওয়া নাসিমা ফেরদৌসীর কথায়।

বরগুনার এই আওয়ামী লীগ নেত্রীকে এখনো শরীরে বিদ্ধ স্পিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে চলতে হয়, এখন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য তিনি। 

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে চালানো ওই হামলার লক্ষ্য যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাই ছিলেন, তা পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে।  

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই ঘটনার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয় বলে পরে উন্মোচিত হয়, আসামির হিসেবে এখন বিচারের সম্মুখীন ওই সময়ের তদন্ত কর্মকর্তারাও।  

অধিকতর তদন্তের পর এখন এই মামলার আসামির তালিকায় তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে যোগ হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের ছেলে তারেক রহমানও।

১০ বছর আগের সেদিন বিকালে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা ছিল আওয়ামী লীগের। শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরপরই তা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু এক সন্ত্রাসে স্তব্ধ হয়ে যায় সন্ত্রাসবিরোধী সেই কর্মসূচি।

সেদিন বেঁচে গেলেও স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমান বসে ছিলেন ট্রাকে তৈরি মঞ্চের সামনে কর্মীদের সঙ্গে, প্রাণ হারান তিনিসহ ২৪ জন। যারা আহত হন, তাদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হন, ঘটে অঙ্গহানি।

গ্রেনেড হামলার দিনটি তাই জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে উঠে এসেছে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাণীতে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের যে ষড়যন্ত্র চলছিল, ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা তারই ধারাবাহিকতা বলে মনে করেন আবদুল হামিদ।

তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন নিহত ২৪ জনকে, সমবেদনা প্রকাশ করেছেন আহতদের প্রতি।

হত্যার উদ্দেশে চালানো ওই হামলায় বেঁচে যাওয়ার নেতা-কর্মীদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন শেখ হাসিনা তার বাণীতে। 

“চারিদিকে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হচ্ছে। এর মধ্যেও আমাদের নেতা-কর্মীরা মানববর্ম সৃষ্টি করে সেদিন আমাকে রক্ষা করে।”

শেখ হাসিনা বলেন, ওই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, শান্তি ও উন্নয়নের ধারাকে স্তব্ধ করে দেয়া। হত্যা, ষড়যন্ত্র, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দুঃশাসনকে চিরস্থায়ী করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করা। বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করা।

হামলার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎপরতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। হামলাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। অনেক আলামত ধ্বংস করে।

“সত্য কখনও চাপা থাকে না। তাই আজ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বিএনপি-জামাত জোটের অনেক কুশীলব এই হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। কোন ভবনে বসে কারা এই হামলার নীলনকশা তৈরি করেছিল, তা স্পষ্ট হয়েছে।”

দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর গ্রেনেড হামলার মামলার বিচার শুরু হয়েছে। হামলাকারী, পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা এবং তাদের মদদদাতাদের সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান হবে বলে শেখ হাসিনা প্রকাশ করেন।

কর্মসূচি

প্রতিবারের মতো এবারো নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করবে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো।

বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ বেদীতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুল দেবেন।

আওয়ামী লীগের সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের নেতারাও এই কর্মসূচিতে যোগ দেবে।

প্রধানমন্ত্রী গ্রেনেড হামলায় নিহত শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এদিন আলোচনা সভায় অংশ নেবেন।

দিনটি পালনের জন্য সারাদেশের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

হামলায় নিহতরা

২১ অগাস্টের হামলায় কেন্দ্রীয় মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমান ছাড়াও নিহত হন আওয়ামী লীগের ২৩ নেতা-কর্মী। এদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম, যিনি দলের  সবার কাছে আদা চাচা নামেই পরিচিত ছিলেন।

সেদিন নিহত হন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স কর্পোরাল মাহবুবুর রশীদও।

নিহত অন্যরা হলেন- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সুফিয়া বেগম, মাদারীপুরের যুবলীগ নেতা লিটন মুন্সী ওরফে লিটু, নারায়ণগঞ্জের রতন সিকদার, ঢাকা মহানগর রিকশা শ্রমিক লীগ নেতা মো. হানিফ, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসিনা মমতাজ রীনা, সরকারি কবি নজরুল ইসলাম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মামুন মৃধা, ঢাকা মহানগর যুবলীগ নেতা বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগকর্মী আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, যুবলীগ নেতা আতিক সরকার, শ্রমিক লীগকর্মী নাসির উদ্দিন সর্দার, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেত্রী রেজিয়া বেগম, আবুল কাসেম, জাহেদ আলী, মমিন আলী, যুবলীগ নেতা শামসুদ্দিন আবুল কালাম আজাদ ও ইছহাক মিয়া।

লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা

সন্ত্রাসের প্রতিবাদে আয়োজিত ওই সমাবেশে শোভাযাত্রার আগে চালানো এই হামলার লক্ষ্য যে ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা, তা পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে।

দিবসের বাণীতে বঙ্গবন্ধুকন্যাও বলেন, “আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ওই হামলা চালানো হয়েছিল।”

সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার ঠিক আগে উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা শুরু হয়, সেই সঙ্গে চলে গুলিবর্ষণও। তা দেখে পুরো দেশ থমকে যায়। 

ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী আর দলীয় নেতা-কর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে আগলে রেখেছিলেন শেখ হাসিনাকে। তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে তার বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুলে ধানমণ্ডির সুধা সদনে নিয়ে যান।

গ্রেনেড হামলার পর সরকারের পক্ষ থেকে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ ওই তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বেসরকারি তদন্ত কমিটিও একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হামলার লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা (এফবিআই), আন্তর্জাতিক পুলিশ (ইন্টারপোল) চাঞ্চল্যকর এ হামলার তদন্তে দু’দফায় ঢাকা আসে। তবে তারা তদন্ত শেষ না করেই ফিরে যান।

অভিযোগ রয়েছে, দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অসহযোগিতার কারণেই আন্তর্জাতিক এই সংস্থাগুলো গ্রেনেড হামলার তদন্তে তেমন কিছু করতে পারেনি।

কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে চার বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন সিআইডি কর্মকর্তা ফজলুল কবীর ২২ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অধিকতর তদন্ত শেষে যে অভিযোগপত্র দেয়া হয়, তাতে শেখ হাসিনাই যে হামলার লক্ষ্য ছিল, তা স্পষ্ট করে বলা হয়।

অধিকতর তদন্ত ও বিচার শুরু

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহহার আকন্দ মামলাটির অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে আসামির তালিকায় যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন। ফলে মোট আসামি হয় ৫২ জন।

মামলার বিচার শুরু হলেও আসামি পক্ষের কারণে তা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমানের অভিযোগ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা রায় বিলম্বিত করতে সাক্ষীদের অপ্রাসঙ্গিক জেরা করছেন। তাছাড়া বিচারকাজ চলাকালীন সময়ে তারা অপ্রয়োজনীয় সাজেশনও দিচ্ছেন।”

ঢাকার আদালতে বিচারধীন এই মামলায় এই পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষে ৯৯ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।

আসামিদের মধ্যে অনেকে আরো মামলায় জড়িত থাকায় তাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে নেয়ার প্রয়োজন হওয়ায়ও শুনানি পেছাতে হচ্ছে বলে জানান রেজাউর রহমান।

তবে তিনি আশাবাদী, সব বাধা পেরিয়ে এই ঘটনার বিচার যতদূর সম্ভব দ্রুতই হবে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোহিতা করেছেন গোলাম মুজতবা ধ্রুব)