বিকল্প শিশু খাদ্যে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় ‘বড় ঘাটতি’

বাজারে বিক্রি হওয়া শিশুখাদ্যে যেসব পুষ্টিগুণ রয়েছে বলে দাবি করা হয়, সেগুলোর প্রায় সবই কৃত্রিম হওয়ায় শিশুর স্বাস্থ্যগঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যায় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2014, 07:37 AM
Updated : 17 August 2014, 11:15 AM

তারা বলছেন, এসব বিকল্প খাদ্যে শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ না হওয়ায় এবং প্রাকৃতিকভাবে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে ঘাটতি থেকে যাওয়ায় ছোটখাট রোগেই শিশুর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।

এছাড়া বয়সের সঙ্গে শিশুর ওজন ও উচ্চতাও ঠিকমতো বাড়ে না, এমনকি মস্তিষ্কের গঠনও ঠিকমতো হয় না।

বাংলাদেশে শিশুদের খর্বাকৃতি হওয়ার পেছনে ৪১ শতাংশ ক্ষেত্রে মায়ের দুধ ঠিকমতো না খাওয়ানোই মূল কারণ বলে ব্র্যাকের হেলথ, নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন প্রোগ্রামের (এইচএনপিপি) সমন্বয়ক (প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর) ডা. রাইসুল হক জানান।

জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ খাদ্য হিসেবে বিশ্বব্যপী স্বীকৃত। এ প্রক্রিয়াটি ‘এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং’ (ইবিএফ) হিসাবে পরিচিত।

বাজারে সাধারণত দুই ধরনের বিকল্প শিশুখাদ্য পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে- জন্ম থেকে ছয় মাস, এক বছর বা দুই বছর বয়সী শিশুদের জন্য ‘বিশেষ ফর্মুলা’য় তৈরি গুঁড়ো দুধ।

অন্যটি ছয় মাসের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার হিসাবে দেয়ার ‘ফর্মুলা ফুড’। এগুলোও গুঁড়ো অবস্থায় প্যাকেটজাত করে বিক্রি হয়।

মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা টিচিং অ্যাসিসটেন্স ফর হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন (তান) ফাউন্ডেশনের মাঠ ব্যবস্থাপক রত্না গোমেজ বলেন, “আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, যে শিশুদের কৌটার দুধ বা বাজার থেকে কেনা বিকল্প খাবার বেশি দেয়া হয়, তাদের দেখতে বেশ স্বাস্থ্যবান মনে হলেও হঠাৎ একটু অসুস্থ হলেই তাদের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। শিশুর ওজন ও অন্যান্য উপাত্তের চার্টে এ ওঠা-নামা আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই।”

শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে নিয়মিত পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেয়া তান ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমগুলোর মধ্যে একটি। ব্র্যাক, সীমান্তিকসহ আরো কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা এ ধরনের কাজ করে।

ব্র্যাকের ডা. রাইসুল হক জানান, নবজাতকের পাকস্থলীর আকার হয় একেবারেই ছোট। ফলে তার ‍ক্ষুধা ও পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য মায়ের দুধই যথেষ্ট।

“জন্মের পর মায়ের দুধ ছাড়া শিশুর মুখে অন্য খাবার দেয়া হলে সহজেই খাবার পাওয়ার অভ্যাস তৈরি হওয়ায় শিশু কষ্ট করে মায়ের দুধ টানতে চায় না। ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে অন্য কোনো খাবার দেয়া হলে সে আর ইবিএফের মধ্যে পড়ে না।

“তবে শিশুর জন্মের পর মায়ের বুকে দুধ আসতে ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এসময় দেখা যায় শিশুকে কিছু খাওয়ানোর জন্য মায়ের চেয়েও বেশি অস্থির হয়ে ওঠেন স্বজনরা।”

কিন্তু নবজাতকের জন্য মায়ের বুকের প্রথম দুধ, যা শাল দুধ বা কলোস্ট্রাম নামে পরিচিত, সেটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। এটি বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাবিদদের মাধ্যমে স্বীকৃত একটি বিষয় বলে জানান তিনি।

ডা. রাইসুল বলেন, “কৌটার দুধ খাওয়ালে অথবা ছয় মাসের পর সাধারণ খাবারের পরিবর্তে কৃত্রিম পুষ্টিযুক্ত বিকল্প খাবার খাওয়ালে বাড়ন্ত শিশুর পুষ্টির চাহিদা যেমন পূরণ হয় না, তেমনি মায়ের দুধ থেকে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শিশুর পাওয়ার কথা তা থেকেও সে বঞ্চিত হয়।”

জন্মের পর থেকে শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করার উদ্যোগ রয়েছে সারা বিশ্বেই। ১৯৮১ সালে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা করে, যা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউটস’ নামে পরিচিত।

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণনের নীতিমালা) আইন’ প্রণয়ন করা হয়।২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর এ আইনটি সংশোধনও করা হয়। সংশোধিত আইনের অধীনে এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা করার কথা বলা হলেও তা এখনো হয়নি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাধারণ দোকান থেকে শুরু করে সুপার শপগুলোতে বিকল্প শিশুখাদ্য ও ফর্মুলা বিক্রি করা হলেও ওই আইন সম্পর্কে তারা অবগত নন।

এমনকি শিশুর মা-বাবাসহ অভিভাবকরাও শিশু খাদ্য হিসেবে মায়ের দুধের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন নন।

ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তারা মায়ের দুধের চেয়ে এসব বিকল্প খাদ্যের উপর নির্ভর করছেন এবং সেগুলোকেই শ্রেয় মনে করে কিনছেন। আর এই প্রবণতা নিম্নবিত্ত অভিভাবকদের চাইতে স্বচ্ছল ও উচ্চবিত্ত অভিভাবকদের মধ্যেই বেশি।