ব্যস্ততা ও ভ্রান্তধারণায় বিকল্প শিশুখাদ্যে ঝোঁক

সারা বিশ্বে শিশুর জন্য মায়ের দুধই সর্বোৎকৃষ্ট খাবার বলে স্বীকৃত হলেও বিভিন্ন কারণে বাজারে বিক্রি হওয়া বিকল্প শিশুখাদ্যের দিকে ঝুঁকছেন অভিভাবকরা। এই প্রবণতা আবার অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত অভিভাবকদের চাইতে স্বচ্ছল ও উচ্চবিত্ত অভিভাবকদের মধ্যেই বেশি।

কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2014, 05:46 PM
Updated : 10 August 2014, 05:46 PM

মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য, যা সাধারণভাবে ‘ফর্মুলা ফুড’ নামে পরিচিত, শিশুকে দেয়ার পিছনে একটি বড় কারণ কর্মজীবী মায়েদের ঘরের বাইরের ব্যস্ততা। তবে অনেক গৃহবধূ মা-ও মায়ের দুধের তুলনায় শ্রেয় মনে করে সন্তানদের দিচ্ছেন ফর্মুলা ফুড।

জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ খাদ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় পুষ্টিগুণ সে পেয়ে থাকে মায়ের দুধ থেকেই।

ফলে শিশুর সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে জন্মের পর থেকেই সে যাতে শুধু মায়ের দুধ গ্রহণ করে, তা নিশ্চিত করার বিষয়ে উদ্যোগ রয়েছে সারা বিশ্বেই। বাংলাদেশেও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন থাকলেও আইনটির বিষয়ে জানা নেই অধিকাংশ মানুষেরই।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিশুর জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর, যা এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং (ইবিএফ) নামে পরিচিত, এর হার ৬৪ শতাংশ।

শিশুদের জন্য মায়ের দুধের গুরুত্ব প্রচার এবং জন্ম থেকে অন্তত দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করে একে একটি সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে সারা বিশ্বে কাজ করছে ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশন (ওয়াবা)। এর সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও।

এ সংস্থার স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ডা. রুখসানা হায়দার বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, আমাদের দেশে ইবিএফর হার বেশ ভালো। কিন্তু এরপর মায়ের দুধের পাশাপাশি যে সম্পূরক খাবার দেয়া শুরু হয়, তখন দেখা যায় মায়েরা ফর্মুলা ফুডের দিকে ঝুঁকে পড়ে।”

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “মূলত মায়েরা সংসার বা সংসারের বাইরে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় শিশুর খাবার তৈরির পিছনে যে বাড়তি সময় দিতে হয়, তা দেয়ার মতো সময় হয়তো তাদের থাকে না। সে তুলনায় ফর্মুলা ফুডটা তৈরি করা সহজ, ফুটানো পানিতে মেশালেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেকেই ফর্মুলা ফুডের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।”

ঢাকার একজন কর্মজীবী মা মাহবুবা আক্তার। তার জমজ সন্তানদের বয়স এখন সাড়ে তিন বছর। দুই মিনিট আগে-পরে জন্মানো সন্তানদের মধ্যে বড়জন মেয়ে, ছোটজন ছেলে।

মাহবুবা বলেন, সাড়ে তিন মাস বা চার মাস বয়স থেকেই তার সন্তানদের বুকের দুধের পাশাপাশি সেরেল্যাক (মাতৃদুগ্ধের বিকল্প খাদ্যের একটি ব্র্যান্ড) খাওয়ানো শুরু করেন।

মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে অফিস শুরু হওয়া এবং সংসারের অন্যান্য কাজের মধ্যে সময়ের স্বল্পতার কারণেই সন্তানদের সেরেল্যাক খাওয়ানো শুরু করেন বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে সিলেটের বালাগঞ্জের গৃহিণী নাদিরা বেগম বলেন, তার দুই বছরের ছেলে দারুল হোসেনকে ছয় মাসের পর থেকেই সেরেল্যাকসহ বাসার সাধারণ খাবারও খাওয়ানো হয়।

কিন্তু ছেলের খাওয়ার রুচি কম এবং সাধারণ খাবারের প্রতি অনীহা থাকায় তাকে সেরেল্যাকই বেশি খাওয়ানো হয়।

কেন সাধারণ খাবার বাদ দিয়ে বিকল্প খাদ্য খাওয়াচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বাচ্চাদের বাবা নিয়ে আসে, আর সবাই বলে এগুলো না কি বেশি ভালো।”

তার চার সন্তানের প্রত্যেককেই মায়ের দুধের পাশাপাশি সেরেল্যাক খাওয়ানো হতো, যদিও ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীরা সাধারণ খাবার খাওয়াতে বলেছিলেন।

তবে বালাগঞ্জের আরেক গৃহিণী সাজমিন বেগম বলেন, তার দুই বছর বয়সী ছেলে আবু সালমান ইমরানকে ছয় মাস বয়স থেকেই বাসার সাধারণ খাবার (ভাত, ডাল, সবজি, মাছ-মাংস) চটকে শিশুর উপযোগী করে খাওয়াচ্ছেন, কখনোই বিকল্প শিশুখাদ্য দেননি।

এ পর্যন্ত তার ছেলের হজমে সমস্যা বা ডায়রিয়া জাতীয় কোনো রোগ হয়নি। দুই বছরের মধ্যে বড় ধরনের কোনো জ্বরও তার ছেলের হয়নি বলে জানান সাজমিন।

প্রায় ২৫ বছর ধরে মাতৃদুগ্ধ পানবিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে আসা ডা. রুখসানা হায়দার বলেন, “সাধারণত ফর্মুলা ফুডগুলোতে কৃত্রিম স্বাদ ও গন্ধ যোগ করা হয়। ওগুলো খেতে মিষ্টি হয়,  তাই বাচ্চারা খেতে বেশি পছন্দ করে।

“কিন্তু খাবার খাওয়ার ব্যাপারটা আসলে অভ্যাস তৈরি করার উপর নির্ভরশীল। সবসময় বিকল্প খাদ্য দেয়া হলে শিশু সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সাধারণ খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করলে শিশু সেইটাই খেতে চাইবে।”

সারা বিশ্বে শিশুদের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে ১৯৮১ সালে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে যা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্টমিল্ক সাবস্টিটিউটস’ নামে পরিচিত। এরপর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণনের নীতিমালা) আইন’ প্রণয়ন করা হয়।

২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর এ আইনটি সংশোধন করা হয়। তবে সংশোধিত আইনের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ১৯৮৪ সালের আইনটি রহিত করা হয়েছে এই আইনেই।

আইন সম্পর্কে না জেনেই দোকানে বিকল্প গুঁড়ো দুধ ও ফর্মুলাগুলো বিক্রি করছেন সাধারণ দোকানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুপার শপগুলো।