ন্যূনতম মজুরি ৪৫০০ টাকার বেশি হলে গার্মেন্ট বন্ধের হুমকি

মজুরি বোর্ডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৪ হাজার ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে পোশাক শিল্প মালিকরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Nov 2013, 01:05 PM
Updated : 5 Nov 2013, 04:27 PM

মঙ্গলবার বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রস্তাব দিয়ে ন্যূনতম মজুরি এর বেশি হলে কারখানা বন্ধের হুমকি দেয়া হয়েছে।

মজুরি বোর্ড সোমবার দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে ন্যূনতম বেতন ৫ হাজার ৩০০ টাকার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে।

বৈঠকে উপস্থিত শ্রমিক প্রতিনিধিরা এই প্রস্তাব মেনে নিলেও মালিক প্রতিনিধিরা এতে একমত না হয়ে বৈঠক থেকে উঠে যায়।

পরে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম জানান, এই বেতন দেয়ার সক্ষমতা তাদের নেই। অন্যদিকে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকার পুরনো দাবি তোলেন।

মজুরি বোর্ডের বৈঠকের একদিন পর কারওয়ানবাজারে বিজিএমইএ ভবনে সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান পোশাক শিল্প মালিকদের প্রধান দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা।

বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, তাদের পক্ষে ন্যূনতম মজুরি সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৫০০ টাকা দেয়া সম্ভব। এর বেশি দেয়া সম্ভবপর নয়।

সর্বনিম্ন মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকার যে প্রস্তাব মজুরি বোর্ড চূড়ান্ত করেছে, তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, “আমরা এই প্রস্তাবের নিন্দা জানাই।”

বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান বলেন, “আমরা বলিনি যে বেতন বাড়াব না। তবে আমাদের সামর্থ্যও বুঝতে হবে। সবারই বিজনেস পলিসি আছে। সে অনুযায়ী এই ৫ হাজার ৩০০ টাকা আমাদের সাথে যায় না।”

তাদের বক্তব্যে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মো. হাতেমসহ সবাই সায় দেন।

মজুরি বোর্ডের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বুধবার আপিল করে নিজেদের প্রস্তাবিত মজুরি কাঠামো মেনে নিতে অনুরোধ জানানো হবে বলে শিল্প মালিকরা জানান।

৪ হাজার ৫০০ টাকার প্রস্তাব আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মেনে না নিলে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এর সদস্যরা সব কারখানা বন্ধ করে দেবে বলে হুমকি দেন আতিকুল।

তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, “আমরা পোশাক কারখানা বন্ধ করতে চাই না। মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত যদি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে পোশাক শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।

“সে কারণে সরকারের কাছে একটা ‘এক্সিট পয়েন্ট’ চাচ্ছি। আমরা শ্রমিকদের সব বেতন-ভাতা দিয়ে চলে যেতে চাই । তবে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের দায় সরকারকে নিতে হবে।”

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক এবং রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের প্রাণহানিতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কর্মপরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের অসন্তোষের মধ্যে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সরকার।

বর্তমানে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার টাকা, শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে ২০১০ সালে যা ঠিক হয়েছিল। এবার শ্রমিক সংগঠনগুলো ৮ হাজার টাকার দাবি তুলে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। 

এর মধ্যে মজুরি বোর্ড মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েকদফা বৈঠকের পরও মতৈক্য না হওয়ায় সোমবার ভোটাভুটিতে নতুন মজুরির প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়। 

মালিক পক্ষের মতামত ছাড়াই একতরফাভাবে ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব করা হয়েছে বলে দাবি করেন বিজিএমইএ সভাপতি।

প্রস্তাব পর্যালোচনা করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের সব কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।  আর আমাদের মোট কারখানার ৭০ শতাংই ছোট ও মাঝারি।

“এটা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক প্রস্তাব।”

ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা বিবেচনায় নেয়া গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ ক্ষেত্রে তা হয়নি, বলেন আতিকুল।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাকের মুল্য যুক্তরাষ্ট্রে ৩ শতাংশ ও ইউরোপে সাড়ে ১৩ শতাংশ কমেছে। ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেড়েছে ১৩ শতাংশ।

এদিকে সরকার উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দশমিক ৮০ শতাংশ করেছে। এছাড়া ট্রাক ভাড়া ৩ শতাংশ, লোডিং-আনলোডিং চার্জ ৫ শতাংশ, ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৮ শতাংশ বেড়েছে।

“সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ৩৭ শতাংশ সক্ষমতা হারিয়েছে,” বলেন বিজিএমইএ সভাপতি।

চীন, ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশে মজুরি নির্ধারণে শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু চীন, ভিয়েতনামে যে ব্যবসা পরিবেশ আছে, তা বাংলাদেশে নেই। চীনে ৫ শতাংশের কম সুদে ব্যাংক ঋণ মিললেও বাংলাদেশে তা পেতে হয় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ সুদ দিয়ে।”

এছাড়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় জানিয়ে আতিকুল বলেন, “একদিনের হরতালে পোশাক শিল্প ২০০ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়ে। চীন, ভিয়েতনামের উদ্যোক্তাদের এসব পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না।”

বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান বলেন, “গত তিন বছরে অনেক খরচ বেড়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখেন। এর মধ্যেও আমরা ভালো করার চেষ্টা করছি, আমাদের করার সুযোগ দেন।”

কারখানা বন্ধের হুমকির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “ইচ্ছে করলেই তো ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না। কারণ এটা পাট, পান বা চায়ের ব্যবসা না। কারখানা বন্ধ করতে হলেও তিন মাসের বেতন দিতে হবে।”

আতিকুল বলেন, “এজন্য আমরা সদস্যদের কাছে মতামত চেয়ে একটি সার্কুলার জারি করব। তাতে যারা কারখানা বন্ধ করতে চান তারা জানাবেন।”  

তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমানো, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দ্রুত দেয়া এবং বন্দরের হ্যান্ডলিং চার্জ কমানোর দাবি সরকারকে জানান বিজেএমইএ সভাপতি।