ঢাকার বাইরে যাচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি আর জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামেও সমাবেশ করবে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2013, 07:08 AM
Updated : 8 March 2013, 12:46 PM

উত্তরা ও আশুলিয়াতেও সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয় শাহবাগের নারী জাগরণ সমাবেশ থেকে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের সম্মানে যা আয়োজন করা হয়।

শুক্রবার বিকালে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার নতুন এই কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, আগামী ১০ মার্চ বিকেল ৩টায় উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরের চৌরাস্তায় সমাবেশ করবে গণজাগরণ মঞ্চ।

এরপর ১৩ মার্চ বিকেলে প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশ হবে। এর আগে সকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ।

এর আগে শাহবাগের বাইরে গণজাগারণ মঞ্চের সমাবশে হয় রায়েরবাজার, মিরপুর, মতিঝিল, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

১৫ মার্চ শাহবাগের আন্দোলনকারীরা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি নিয়ে যাবে আশুলিয়ায়।

এছাড়া আগামী ১৬ মার্চ সকাল ১১টায় জামায়াত-শিবিরের নৃশংসতার প্রতিবাদে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্প্রীতি সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেন ইমরান।

ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার সমাবেশ শেষে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় ও তা কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ পড়ান।

তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে হাজার হাজার মানুষ শপথ নেন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ না করা পর্ন্ত ‘লড়াই’ চালিয়ে যাওয়া আর যুদ্ধাপরাধীদের সব অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম বয়কট করার।

ইমরান বলেন, মনে রাখা দরকার একাত্তরের যে ঘৃণ্য নারী নির্যাতন হয়েছিল ৪২ বছরেও তার কোনো বিচার হয়নি।

“যে যুদ্ধাপরাধীরা বাংলার মা-বোনদের বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ছয় দফা দাবি অর্জিত না হওয়া পর্ন্ত আমাদের আন্দোলন চলবেই। একই সঙ্গে আমরা সচেতন হব নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূরীকরণে।”

এর আগে গণজাগরণ মঞ্চের কাছে কয়েকটি হাতবোমা বিস্ফোরিত হলেও জামায়াত-শিবিরকে প্রতিরোধের স্লোগান দিয়ে চলে সমাবেশের কার্যক্রম।

শুক্রবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ওই বোমার বিস্ফোরণে একজন র‌্যাব সদস্য আহত হন।

বোমা বিস্ফোরণের পরপরই মঞ্চ থেকে টিআইবির চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল বলেন, “বোমা বিস্ফোরণের যে ঘটনা ঘটছে তা অপ্রত্যাশিত কিছু না। একাত্তরে যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল তারা আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতেই থাকবে। তাতে আমাদের আন্দোলন থামবে না।”

বিস্ফোরণের পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে স্লোগান দেন আন্দোলনের নারীকর্মীরা যাতে কণ্ঠ মেলায় হাজার হাজার মানুষ। আবারও শুরু হয় সমাবেশ।

এর আগে নারায়ণগঞ্জের গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মোহাম্মদ ত্বকির স্মরণে সমাবেশে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

নিখোঁজ হওয়ার দুদিন পর শুক্রবার শীতলক্ষ্যা নদী সংলগ্ন একটি খালে তানভীরের  লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

বিকেল সাড়ে ৪টায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নারীদের এই জাগরণ সমাবেশ। সমাবেশ পরিচালনা করেন কানিজ আকলিমা চিনু যাতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা এবং ছাত্র সংগঠনের নারী নেত্রীরা বক্তব্য রাখেন।

অগ্নিকণ্ঠিখ্যাত লাকি আক্তার বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে এই মঞ্চের আন্দোলনে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এ আন্দোলনের মঞ্চ কোনো দলীয় মঞ্চ না, এটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির মঞ্চ।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফেডারেশর সভাপতি সামিয়া রহমান বলেন, যখনেই নারী তার ন্যায্য দাবি আদায়ে মাঠে নেমে এসেছে তখনই প্রতিক্রিয়াশীল তাদের বিরোধিতা করে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছে।

জাসদ ছাত্রলীগের সদস্য শ্রাবন্তি আকতার বর্ষা বলেন, “সবাই যখন ফাঁসির দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে তখন খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হয়েও কিভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কথা বলেন, তাদের সমর্থন করেন?”

“রাজাকারের পক্ষ ত্যাগ করে গণজাগরণের পক্ষে আসুন। জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে একাত্মতা প্রকাশ করুন।”

ইডেন কলেজের সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মুক্তা বাড়ৈ বাংলাদেশের ইতিহাসে মহিয়সী বিভিন্ন নারী নেত্রীর অবদানকে স্মরণ করেন।

বাধা বিপত্তি ও ভয়ভীতি সৃষ্টির পরেও নারীরা শাহবাগে উপস্থিত হওয়ায় মঞ্চে উঠে তাদের অভিনন্দন জানান এভারেস্টবিজয়ী ওয়াসফিয়া নাজরীন।

ছাত্রমৈত্রীর সহসভাপতি অনিমা সুলতানা শাওন বলেন, যারা শহীদ মিনার ভেঙেছে, জাতীয় পতাকা ছিড়েছে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারে না। তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হোক।

অন্যান্যদের মধ্যে ডাকসুর সাবেক ভিপি শারমিন সুলতানা লিপি, কানিজ ফাতেমা যুথি, নাট্যব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার, কাজী রোজী বক্তব্য দেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরিন শারমিন চৌধুরী, সাংসদ মেহের আফরোজ চুমকি, শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, নাট্যব্যক্তিত্ব রোকেয়া প্রাচী, ত্রপা মজুমদার, নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপাসহ বিভিন্ন অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত নারী নেত্রীরা নারী জাগরণের এই সমাবেশে যোগ দেন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন রাজধানীতে পতাকা মিছিল করে।

একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের সম্মানে শুক্রবার বিকেলে প্রজন্ম চত্বরে এই সমাবেশের ঘোষণা থাকলেও দুপুর ১টার পর থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সেখানে জড়ো হন নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। জাদুঘরের ঠিক সামনে টিএসসিমুখী মঞ্চের আশপাশের এলাকা বিকাল ৩টার আগেই পূর্ণ হয়ে যায়।

তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় নারী আর শিশুদের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা বয়সী নারীরা ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চে আসতে শুরু করে। অনেকের মাথায়ই জাতীয় পতাকা আর যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি সম্বলিত ব্যান্ড দেখা গেছে।

যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান করে তার ফাঁসির দাবিতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শাহবাগের গণআন্দোলনে শরিক হচ্ছেন রিকশাচালক থেকে মন্ত্রী, স্কুল শিক্ষার্থী থেকে মুক্তিযোদ্ধারা।

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি তোলে তারা, যা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।