মুসা ইব্রাহীমসহ তিন অভিযাত্রীকে নিরাপদে উদ্ধার

ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট কারস্টেনজ অভিযান শেষে বেইজ ক্যাম্পে পাঁচ দিন আটকে থাকা বাংলাদেশের পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীমসহ তিন অভিযাত্রীকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়েছে।

ওমর শরীফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2017, 03:26 AM
Updated : 19 June 2017, 09:46 AM

গত দুই দিনে দুই দফা ব্যর্থ হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া কিছুটা ভালো হলে বাংলাদেশ সময় সোমবার ভোর ৫টা ২৩ মিনিটে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ২৫৭ মিটার উচ্চতায় মাউন্ট কারস্টেনজের ওই বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছায় হেলিকপ্টার।

এরপর সাড়ে ৫টার দিকে হেলিকপ্টারে করে রওনা হয়ে আধা ঘণ্টার মাথায় তারা পাপুয়া প্রদেশের তিমিকা বিমানবন্দরে পৌঁছান বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহীম।  

তার সঙ্গে এই অভিযানে ছিলেন ভারতের এভারেস্টজয়ী দুই পর্বতারোহী সত্যরূপ সিদ্ধান্ত ও নন্দিতা চন্দ্রশেখর।

ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারে মুসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা ভালো আছেন। তবে কারস্টেনজ পিরামিডে সামিট শেষে ফেরার পথে নন্দিতার ‘হাইপোথারমিয়া’ হয়েছিল। খাবারও ফুরিয়ে গিয়েছিল। সেজন্য দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়েছে।

“চারদিন না খেয়ে থাকার এই অভিজ্ঞতা মিশ্র অনুভূতি... এই কয়দিনে ওজন কমেছে সাড়ে আট কেজির মত।”

সব কিছু ঠিক থাকলে ২১ তারিখ দেশে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন মুসা ইব্রাহীম।

 
 

২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছানোর কৃতিত্ব দাবি করেন মুসা ইব্রাহিম, যদিও এ নিয়ে পরে বিতর্ক তৈরি হয়।

এবার তিনি যে চূড়ায় অভিযানে গেছেন, সেই কারস্টেনজ পিরামিডে ২০১৫ সালের নভেম্বরে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে সেভেন সামিট (সাত মহাদেশের সাত সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়) পূর্ণ করেন এভারেস্টজয়ী দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী ওয়াসফিয়া নাজরীন।

কারস্টেনজ জয়ের মধ্যে দিয়ে এবার সেভেন সামিট পূর্ণ করা সত্যরূপ সিদ্ধান্তের ভাষায়, তাদের এই অভিযান ছিল ‘সব অ্যাডভেঞ্চারের বাবা’।

চারদিন প্রায় অভুক্ত থেকে তিনিও ওজন হারানোর কথা ফেইসবুকে জানিয়েছেন। তিমিকায় ফেরার পর সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি গাইডের সঙ্গে তাদের তিনজনের ছবি এবং পেটপূজার আয়োজনের ছবি তিনি শেয়ার করেছেন সবার সঙ্গে।

 

লেখা আছে হৃদয়ে

পর্বতারোহী রেইনল্ড মেসনারের তালিকা অনুসারে সাত মহাদেশের সাত সর্বোচ্চ পর্বত চূড়ার (সেভেন সামিট) একটি হল কারস্টেনজ পিরামিড, যা ওশেনিয়া অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।

ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রভিন্সে কারস্টেনজ পর্বতমালায় ৪ হাজার ৮৮৪ মিটার উঁচু ওই শৃঙ্গ স্থানীয়ভাবে পুঞ্চাক জায়া নামেও পরিচিত।

এই অভিযানে অংশ নেওয়ার জন্য ২৯ মে ইন্দোনেশিয়ার বালি হয়ে পাপুয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন মুসা ইব্রাহীম। বালিতে তার সঙ্গে যোগ দেন সত্যরূপ ও নন্দিতা। পরে পাপুয়ার নাবির থেকে শুরু হয় মূল অভিযান, যার নাম দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ এক্সপেডিশন টু মাউন্ট কারস্টেনজ পিরামিড’।

সত্যরূপের স্যাটেলাইট কমিউনিকেটরের রেকর্ড অনুযায়ী, ৬ জুন সুগাপা পুলিশ স্টেশন থেকে ছয় দিন ট্রেকিং করে তারা প্রথমবার বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছান। বাংলাদেশ সময় ১৩ জুন সকাল ৮টা ৪৯ মিনিটে তিন অভিযাত্রী পৌঁছান কারস্টেনজের চূড়ায়।

 

চূড়া থেকে সেদিন বিকালেই বেইজ ক্যাম্পে ফিরে আসেন অভিযাত্রীরা। পরদিন ফিরতি পথে রওনা হওয়ার কথা থাকলেও আটকা পড়েন তারা।

এর মধ্যে রসদে টান পড়ায় এবং আবহাওয়ার উন্নতি না হওয়ায় ১৫ জুন ট্রেকিং বাদ দিয়ে হেলিকপ্টারে করে ফেরার কথা ভাবতে শুরু করেন মুসারা। স্যাটেলাইট ফোনে যার যার দেশে যোগাযোগও শুরু করেন।

তাদের আটকা পড়ার খবর বাংলাদেশে পৌঁছালে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা। মুসার পর্বতারোহণ সংগঠন এভারেস্ট একাডেমির সদস্য এবং বেশ কয়েকজন বন্ধু-সুহৃদ সাহায্যের আবেদন ছড়িয়ে দেন। তাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে।

শাহরিয়ার আলম রোববার ভোরে ফেইসবুকে জানান, স্যাটেলাইট কমিউনিকেটরের  মাধ্যমে সত্যরূপের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। তিমিকাতে হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতীয় দূতাবাস এবং আসিয়ান দপ্তর পুরো বিষয়টির  তদারক করছে। আবহাওয়া ভালো হলেই উদ্ধারের চেষ্টা শুরু হবে।

আবহাওয়া কিছুটা ভালো পেয়ে রোববার সকালে হেলিকপ্টার একবার রওনা হলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে নামতে না পেরে ফিরে যায় বলে মুসার স্ত্রী উম্মে সরাবন তহুরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান। 

মুসার  বোন নূর আয়েশা রোববার ফেইসবুকে জানান, পাপুয়ার তিমিকা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ওড়ার অনুমতি দিতেই চার ঘণ্টা সময় লাগিয়ে দেয়। ততক্ষণে আবহাওয়া আবারও খারাপ হয়ে যায়।

স্যাটেলাইট কমিউনিকেটরে মুসার বার্তা

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে রোববার দুপুরে সত্যরূপের স্যাটেলাইট কমিউনিকেটরে যোগাযোগ করা হলে সাড়া দেন মুসা।

তিনি জানান, যে ক্যাম্পে তারা আছেন সে জায়গার নাম লেক ভ্যালি। খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় আগের ক্যাম্পারদের ফেলে যাওয়া খাবার খুঁজে নিয়ে তাই দিয়ে কাজ চালাচ্ছেন।

এদিকে রাত নেমে আসায় রোববারের মত মুসাদের উদ্ধারের চেষ্টা বাদ দেওয়া হয়। শুরু হয় দিনের আলো আর অনুকূল আবহাওয়ার অপেক্ষা। মাউন্ট কারস্টেনজের বেইজ ক্যাম্পে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে স্থানীয় সময় সাড়ে ৮টার দিকে। 

হেলিকপ্টারে চড়ে তিমিকার পথে উড়াল দেওয়ার পর সত্যরূপ তার স্যাটেলাইট কমিউনিকেটরের মাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় লিখেছেন- অনেক গল্পই হয়ত কখনও বলা হবে না, কোনো দলিলে তা লেখা থাকবে না; কিন্তু সেসব কথা অমলিন থাকবে হৃদয়ে।