রোববার ভোর ৫টায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয় তাদের এই পদযাত্রা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, মধুর ক্যান্টিন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শিখা চিরন্তন, সিটি কলেজ, মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ, রায়ের বাজার বধ্যভূমি, সাদুল্ল্যাপুর ঘাট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ ঘুরে আবার শহীদ মিনারে এসে শেষ হয় ‘অদম্য পদযাত্রা’।
পর্বতারোহীদের সংগঠন ‘অভিযাত্রী’ ২০১৩ সাল থেকে ‘শোক থেকে শক্তি’ নামে একটি পদযাত্রার আয়োজন করে আসছে। ২০১৬ সাল থেকে এই পদযাত্রা নিবেদিত হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে।
অভিযাত্রী দলের অন্যতম সদস্য নিশাত মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত দীর্ঘ এই পদযাত্রায় পুরোটা পথ না হেঁটে ন্যূনতম এক মাইল হেঁটেছেন ছাত্র-শিক্ষক-কর্মজীবী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ।
তারা সাধ্যমতো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিলে অনুদান দিয়েছেন।
নিশাত জানান, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পদযাত্রীদল মায়ের ভাষার জন্য আত্মত্যাগকারী মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত হন। ভোর ৫টায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের সঙ্গে তারা কণ্ঠ মেলান জাতীয় সংগীতে।
এরপর ২৫ মার্চ কাল রাতের ভয়াল স্মৃতি বিজড়িত জগন্নাথ হল, মধুর ক্যান্টিন পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই মহান কবিতা- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এর প্রথম উচ্চারণক্ষেত্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছান তারা। শিখা চিরন্তনে কিছুটা সময় নীরবতা পালন করে শাহবাগ হয়ে সিটি কলেজে পৌঁছায় অভিযাত্রী দল।
পিলখানা, জিগাতলা হয়ে তাজউদ্দিন আহমেদের স্মৃতিধন্য বাসভবনের পাশ দিয়ে মোহাম্মদপুরের সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজে পদযাত্রীদল পৌঁছায় সকাল সাড়ে ৮টায়।
একাত্তরে বর্বর পাকিস্তানি-বাহিনী ও তাদের দোসর আল-বদর গোষ্ঠী পাশবিক নির্যাতনের ভয়ঙ্কর ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছিল এখানে। বুদ্ধিজীবীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন শেষে এখান থেকেই তাদের নেওয়া হয় বধ্যভূমিতে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটায় পদযাত্রী দল। তারপর বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে তারা।
তারপর বছিলা সেতু ঘাট থেকে নৌকায় চেপে তারা যান আমিনবাজারে। তুরাগ নদীর বাঁকে-বাঁকে ধান ক্ষেতের ফাঁকে-ফাঁকে একাত্তরের স্মৃতি জাগানিয়া বুড়ো হিজলের পাশ দিয়ে নৌকায় করে পদযাত্রী দল দুপুর ১২টায় পৌঁছায় সাদুল্ল্যাপুরের শতবর্ষী বটমূলে। সেখানে তারা সাক্ষাৎ করে বেগুনবাড়ি স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে। খানিকটা সময় কাটিয়ে তারা চলে আকরাইনের পথে।
নিশাত মজুমদার বলেন, “পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিকামী বাঙালির সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতি ঘেরা কলমা গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটার সময় পদযাত্রী দলের মানসপটে ভেসে উঠল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রায় শেষ পর্বের এক অসম যুদ্ধের স্মৃতি। পাকিস্তানি বাহিনীকে নাজেহাল করে এখানেই শহীদ হন অমিত-তেজ তরুণ টিটো।”
এখান দল চলতে থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগে ডেইরি ফার্ম গেটে শহীদ টিটোর সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে পদযাত্রী দল।
পদযাত্রী দলটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পৌঁছায় বিকাল ৪ টায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলানের নেতৃত্বে ছাত্র-শিক্ষকের সম্মিলনে পদযাত্রী দল চলতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর প্রান্তের স্কুল গেটে। এই পথে গোকুলনগর গ্রামের মেঠো পথ ধরে চলতে থাকে তারা।
তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে অভিযাত্রী পরিচালিত ‘শোক থেকে শক্তি: অদম্য পদযাত্রা’য় শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন ভাষাসৈনিক আহমেদ রফিক, সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব:) কে এম শফিউল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম, লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের নেতা শহীদ আসাদের ভাই এইচ এম মনিরুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি নাট্য ব্যক্তিত্ব সারা যাকের, মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, বিএমটিসি ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং উত্তর মেরু অভিযাত্রী ইনাম আল হক, এভারেস্ট শৃঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকারী পর্বতারোহী এম এ মুহিত ও নিশাত মজুমদার, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন, এস এ গেমসে স্বর্ণজয়ী মাবিয়া আক্তার সীমান্ত।