তার মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বিবেচনা করে তাতে ‘প্ররোচনার’ দায়ে তার স্বামী মোহাম্মদ আসিফ প্রিসলিকে আদালত ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে।
আর সিফাতের শ্বশুর অ্যাডভোকেট হোসেন মোহাম্মদ রমজান, শাশুড়ি নাজমুন নাহার নজলী এবং প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান জোবাইদুর রহমানকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত।
সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণার সময় ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ তার পর্যবেক্ষণে বলেন, যৌতুকের কারণে সিফাতকে মারধরের অভিযোগ এ মামলায় প্রমাণিত হয়নি।
“পুলিশ এ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি হত্যা না আত্মহত্যা সেটা নিয়ে পুলিশ নিজেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। প্রশ্নের সুরাহা না করেই পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্দশ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন সিফাত। কলেজ জীবনের বন্ধু আসিফের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ২০১০ সালে। পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে এই দম্পতির।
২০১৫ সালের ২৯ মার্চ রাতে রাজশাহী শহরের মহিষবাথান এলাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে সিফাতকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক জানান, আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
ওই ঘটনার পর নগরীর রাজপাড়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন সিফাতের চাচা মিজানুর রহমান খন্দকার। ওই তরুণীর শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল জানিয়ে যৌতুকের জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় মামলার এজাহারে।
অন্যদিকে সিফাতের শ্বশুরবাড়ির লোকজন দাবি করে, তাদের পুত্রবধূ ‘আত্মহত্যা’ করেছে। ময়নাতদন্তের পর রাজশাহী মেডিকেলের চিকিৎসক জোবাইদুর রহমানও বিষয়টিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে ঘোষণা করেন।
রংপুর মেডিকেলের তিন চিকিৎসকের করা দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিফাতের মৃত্যু হয়েছে ‘মাথায় আঘাতজনিত কারণে’।
রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ প্রথমে এ মামলা তদন্ত শুরু করলেও পরে তা সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়।
সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী সুপার আহমেদ আলী গতবছর ২৩ মার্চ রাজশাহীর মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যে অভিযোগপত্র দেন, তাতে সিফাতের স্বামীর সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ি ও প্রথম ময়নাতদন্তের চিকিৎসককেও আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসিফের পরিবার গলায় ফাঁস দেওয়ার কথা বললেও সিফাতের মৃত্যু হয়েছিল ‘দেয়াল বা চৌকিতে মাথার পেছনের অংশে আঘাতের’ কারণে। আর প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক আসামিদের ‘বাঁচানোর চেষ্টায়’ আত্মহত্যার ‘মিথ্যা প্রতিবেদন’ দিয়েছিলেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ‘যৌতুকের দাবিতে হত্যার’ অভিযোগ আনা হয় অভিযোগপোত্র। বাদীপক্ষের আবেদনে গতবছর ১২ জুলাই মামলাটি রাজশাহী থেকে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষে ৩২ জনের মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্য শুনে সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ।
রায়ের আগে তিনি বলেন, “এটি একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। বেশি গুরুত্ব দিয়েই পড়েছি। আমার কাছে যতটুকু মনে হয়েছে, যে মেধা আছে, সে অনুযায়ী এ রায় তৈরি করেছি।”
মৌখিক পর্যালোচনায় বিচারক বলেন, সিফাত ও আসিফ একসঙ্গে কলেজে পড়ত; প্রেম থেকে তাদের বিয়ে হয়।
“বিচার করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, সিফাতের পরিবার, অর্থাৎ তার বাবা-মা এ বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। আর তাদের মধ্যে ঝগড়া বা মারামারি, অথবা যৌতুক চাওয়ার কোনো প্রমাণ মামলার বিচারকালে পাওয়া যায়নি।”
রায় ঘোষণার সময় বিচারক প্রশ্ন করেন, এটি হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকলে প্রথম ময়নাতদন্তের সময় কেন সিফাতের পরিবার প্রতিবাদ করল না? কেন ঘটনার চারদিন পর এজাহার করা হল? কেন কয়েকমাস পরে গলিত লাশের ময়নাতদন্ত করা হল?
“আর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে হত্যা কীভাবে হল, হত্যার মোটিভ কী ছিল, তা উন্মোচন করতে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তাও ব্যর্থ হয়েছে। বার বার আসিফকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেও দ্বিতীয়, তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা কিছুই বের করতে পারেনি।”
বিচারক বলেন, ঘটনার সময় আসিফ বাসা থেকে দূরে একটি জায়গায় ক্যারম খেলছিলেন বলে একজনের সাক্ষ্যে এসেছে।
তবে ‘সিফাতের আত্মহত্যায় আসিফের প্রারোচনার’ বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ জানা যায়নি রায়ের কপি না পাওয়ার কারণে। নথি দেখতে চাইলে ট্রাইবুনালের কর্মচারীরা সাংবাদিকদের ফিরিয়ে দেন।
রায় শুনে আদালতে উপস্থিত সিফাতের মা ফারজানা বানু কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মামলার বাদী সিফাতের চাচা সাবেক ব্যাংকার মিজানুর রহমান এ রায়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা হাই কোর্টে আপিল করবেন। সেখানে সর্বোচ্চ সাজার আবদেন করা হবে।
সিফাতের বাবা আমিনুল ইসলাম এজলাসের বারান্দায় সাংবাদিকদের বলেন, “বিয়ে আমরা মেনে নিইনি সত্য কথা নয়। বিয়ের পরপরই আমরা ছেলেপক্ষকে ডেকে অনুষ্ঠান করি। যৌতুক চাইছিল বলে ১৪ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সিফাত আমার বাড়িতে ছিল। তার আগে ডিসেম্বর থেকেই আমি সিফাতকে টাকা পাঠাতাম।”
তাছাড়া তিন মাসের মধ্যে লাশের ময়নাতদন্ত হওয়ার আরও বিচারিক নজির আছে মন্তব্য করে আমিনুল বলেন, “আমরা এ রায় প্রত্যাখ্যান করছি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করব।”
বাদীপক্ষের আইনজীবী জসীমউদ্দিন বলেন, “আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পাইনি। তবে মৌখিকভাবে তিনি যে ব্যাখ্যা করলেন, তাতে কিছুই বুঝলাম না।”
তিনি বলেন, আদালত আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে আসামি আসিফকে সাজা দিয়েছে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায়। অথচ এ মামলায় অভিযোগ গঠন হয়েছিল যৌতুকের জন্য হত্যার ধারায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে।
“বিচারক অভিযোগ গঠনের সময়ই এই মামলা দণ্ডবিধিতে বিচারের জন্য অন্য আদালতে পাঠিয়ে দিতে পারতেন। আর ময়নাতদন্তে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেল, সেগুলো কোথায় গেল, তাও বোঝা গেল না।”
মামলা থেকে খালাস পাওয়া আসিফের বাবা রাজশাহী বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হোসেন রমজান এবং মা হোমিও চিকিৎসক নাজমুন নাহার রায়ের পর তাদের দণ্ডাদেশ পাওয়া ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন।
খালাস পাওয়া ডা. জোবাইদুর রহমানের আইনজীবী ফারুক আহম্মদ বলেন, “লাশ পচে গলে গেছে, ৮৪ দিন পর আবার ময়নাতদন্ত হয়েছে, তখন হেমাটোমা (জখম) কীভাবে ধরা পড়বে?”
তিনি দাবি করেন, “মেয়েটি মানসিক অসুস্থ ছিল, আত্মহত্যা করেছে। ডায়রিতেই সেসব পাওয়া গেছে।”