অনিকেত শহীদ কাদরীর জীবনে দাঁড়ি

“না, না, তার কথা আর নয়, সেই বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো- শহীদ কাদরী বাড়ি নেই”

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2016, 05:38 PM
Updated : 31 August 2016, 07:16 AM

কবিতার ভেতর থেকে বেরিয়ে কবি শহীদ কাদরী মহাকালে হারিয়ে গেছেন রোববার। মাত্র কদিন আগেই, ১৪ অগাস্ট ৭৪তম জন্মবার্ষিকীর খবর সংবাদের শিরোনাম থেকে মুছবার আগেই থেমে গেছেন তিনি।

দেশভাগের যন্ত্রণা, ’৭১ এর মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ আর ’৭৫ এর হত্যাযজ্ঞের অভিজ্ঞতায় বারবার বাস্তুচ্যুত কবির জীবনের শেষ সময় কেটেছে সুদূর নিউ ইয়র্কে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলিতে যখন কলকাতার আকাশে গর্জন করছে বোমারু বিমান সেসময় ১৯৪২ সালের ১৪ অগাস্ট জন্ম তার। চল্লিশের দাঙ্গায় সন্ত্রস্ত কাদরী পরিবার কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন অনেকদিন।

পরে দেশভাগে ভাগ হয়ে যায় তার শৈশবও। পরিবারের সঙ্গে জীবন স্থানান্তর ঘটে বালক শহীদ কাদরীরও। তবে শৈশবের কলকাতা পরিণত জীবনেও হাতছানি দিত তাকে। মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থে তিনি দাঁড়িয়েছেন বাংলা কবিতার হৃদপিণ্ডে।

আজন্ম নাগরিক কাদরী তার জীবনবোধে তিরিশ উত্তর আধুনিকতাকে সঞ্চারিত করে বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন নতুন স্পন্দন। নগর জীবনের নৈকট্য ও দূরত্বকে ভাষা, ভঙ্গি ও বক্তব্যে ঋদ্ধ করেছেন তিনি। শহর এবং সভ্যতার বিষাদ ও বিচ্ছিন্নতাও উঠে এসেছে তার কাব্যে।

“আমি করাত-কলের শব্দ শুনে মানুষ।

আমি জুতোর ভেতর, মোজার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ।”

কলকাতার পর ঢাকার আবাস ছেড়ে জার্মানির কোলন শহর, আমেরিকার বোস্টন ঘুরে শেষ আবাস নিয়েছিলেন নিউ ইয়র্কে। বারবার বসত বদলানো কবির অভিমানের কথা পরিষ্কার করে আসেনি তার কোনো লেখায় বা বক্তব্যে।

“হে আমার শব্দমালা, তুমি কি এখনও বৃষ্টি-ভেজা

বিব্রত কাকের মতো

আমার ক্ষমতাহীন ডাইরির পাতার ভেতরে বসে নিঃশব্দে ঝিমুবে।”

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার মতে, কবির কবিতায় শুধু শহুরে জীবন নয়; একই সঙ্গে শহর ও নগরের জীবনধারার অদ্ভুত মিশ্রণ করতে পেরেছিলেন তিনি। ফলে ষাটের দশকে তার হাত দিয়ে বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র ধারার উন্মেষ ঘটে।

রচনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন কবি শহীদ কাদরী।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের ‘বইঘর’ প্রকাশনা থেকে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশিত হয়। সেই সময় কবি শামসুর রাহমানের বিধ্বস্ত নীলিমা, কবি আল মাহমুদের ‘কালের কলস’ কাব্যগ্রন্থও ওই প্রকাশনী থেকে আসে।

নূরুল হুদা বলছেন, “এই তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হওয়ার পরই বাংলা সাহিত্যের তিনজন প্রধান কবিকে চিহ্নিত করা হয়। সমকালীন বাংলা কবিতায় এই তিনজনকে নিয়ে একটি ত্রিভূজ গঠিত হয়েছিল।

“শহীদ কাদরী ছিলেন চিন্তায় এবং অভিব্যক্তিতে পরিপূর্ণ নাগরিক কবি। খুব বেশি কবিতা লেখেননি। চারটা কি পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে তার। আর এতেই পেয়ে গেছেন স্বতন্ত্র পরিচয়।”

“সুতরাং তার মৃত্যু মানেই হচ্ছে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র ধারার অবসান।”

১৯৫৬ সালে যখন ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশিত হয় তখন শহীদ কাদরীর বয়স ২৫ বছর। এর প্রায় দুই দশক পর ১৯৭৪ প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’।

এর চার বছর পর প্রকাশিত তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে কয়েক বছর আগে শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ প্রকাশিত হয়।

১৯৭৮ সালে জার্মানিতে যান শহীদ কাদরী। বছর চারেক বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেশে এসে দৈনিক সংবাদ- এ কাজ শুরু করেন।

১৯৮২ সালেই আবার পাড়ি জমান লন্ডনে। সেখান থেকে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০ বছর বস্টনে থাকার পর ২০০৪ সাল থেকে নিউ ইয়র্কে বাস করছিলেন তিনি।