এর আগে শেষ কবে ঈদে নতুন পোশাক পেয়েছিলেন, তা মনে করতে পারেন না কারওয়ান বাজার বস্তির বাসিন্দা সেলিনা হোসেন।
পাশেই কারওয়ানবাজারে দিন-রাত বিকিকিনি ব্যস্ততা, রাস্তা পার হলেই বসুন্ধরা সিটি, ঈদ উৎসবে ‘বড়লোকের’ শপিংয়ের ধুম... তাতে সেলিনার কী?
অনিশ্চিত বস্তিজীবনে, অনটনের দিনযাপনে সেলিনাদের মত মানুষের কাছে ‘ঈদ প্রস্তুতি’ শব্দবন্ধটির আলাদা কোনো অর্থ নেই।
“গরীবের আবার ঈদ আছে নাকি?... এমনও মানুষ আছে টাকা গণতে গণতে শেষ করতে পারে না, খাইতে খাইতে মন চায় না। আর আমরা সারা বছর একটা ফলও খাইতে পাই না,” বলেন ত্রিশোর্ধ্ব এই নারী।
পাঁচ সন্তানের মা সেলিনার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণায়। ৮৮ সালের বন্যার এক বছর পর মা-বাবার কোলে চড়ে আশুলিয়ায় আসেন ছোট্ট সেলিনা। এরপর দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেন ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে।
কাজের শক্তি হারিয়ে ফেলার পর মা-বাবা ফিরে যান গ্রামে। শহর ঢাকায় এক মোবাইল মেকানিকের হেল্পারের সঙ্গে বিয়ে হয় সেলিনার।
“কষ্টের মইধ্যে থাকি, তারপরেও পোলাপানের লাইগা ঈদে কিছু তো কিনন লাগে। তয় আমরা বউ জামাই বাদ থাহি। মাইয়্যায় এইবার কষ্টের টেকা ভাইঙ্গা মা-বাপের শখ পূরণ করছে।”
ঈদের জামার কথা জানতে চাইতেই সেলিনার দ্বিতীয় শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে ‘সুখী’র মুখে ফুটে ওঠে আনন্দের হাসি; জানায়, ঈদে সে এবার ‘পরী’ জামা পেয়েছে।
পাশে বসা রাজিয়া বেগমের দিকে ইঙ্গিত করে সেলিনা বললেন, এতো কষ্টের মধ্যেও বস্তির আরও অনেকের চেয়ে ভালো আছেন তিনি।
রাজিয়া বেগম এসেছেন কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলা থেকে। ঈদের কথা বলায় নিষ্পলক আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ।
তারপর বললেন, “ঈদ কি? ঈদের কিছু নাই। মানুষ দিলে খাই, না দিলে খাই না। ঈদ করুম ক্যামনে?”
কৈশোরে পা দেওয়া একমাত্র ছেলে এক সময় হোটেলে কাজ নেওয়ার পর দিন বদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন বিধবা রাজিয়া। কিন্তু অল্প দিনেই ছেলে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে কি করে, মা নিজেও তা ‘বুঝতে পারেন না’।
রাজিয়াকে এখন থাকতে হয় মেয়ের সংসারে। মেয়ে, মেয়ের স্বামী আর দুই নাতি-নাতনিসহ এক ঘরে গাদাগাদি জীবনে নতুন করে স্বপ্ন দেখার জায়গা কোথায়?
এ বস্তির বাসিন্দা মিনারা বেগমের জীবনের গল্প একটু আলাদা। সংসারের এক ফাঁকে কবে কীভাবে যেন হারিয়ে গেছেন স্বামী। এক বছরের বেশি হল তার কোনো খোঁজ নেই। এখন মিনারার জীবন চলে বুয়ার কাজ করে।
“বাসা বাড়িতে কাম করি; জামা-কাপড়, খাওন-দাওন দেওইন্যা নাই। তাই ঈদও নাই,” বলেন মিনারা।
ভোলার চরফ্যাশনের মনোয়ারা খাতুনের স্বামী দিনমজুরি করেন। ঈদের কথা বলতে তার চোখে মুখে দেখা গেল স্পষ্ট বিরক্তি।
“ভোর রাইতে ভাত খাইতে গেলে লবণ দিয়া, পিঁয়াজ দিয়া খাইতে হয়। খাওনের নাই ঠিক, আবার ঈদ।
“কাম (স্বামীর) থাকলে কোনো রকমে চলি। কাম না থাকলেতো ভিক্ষাও করন যায় না। কি একটা সাদা গাড়ি নাকি বাইর অইছে, ভিক্ষা করতে চাইলে নাকি লইয়া যায়।”
২৫ বছর আগে রংপুর থেকে ঢাকায় আসা ইয়াসমিন বেওয়ার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে থাকে কাছেই, তবে খোঁজ খবর নেয় না। তাই নিজে আলাদা ঘর নিয়ে থাকেন, সেখানে ভাত রান্না করে বিক্রি করে চলেন।
ইয়াসমিনের ঘরে ৪০ টাকায় এক বেলার খাবার মেলে। ভাত বিক্রির লাভের টাকায় তার দিন চলে কোনোক্রমে।
“ঈদে মানুষ পোলাও কোরমা কত কিছু খায়। আমরা সেমাই চিনিও কিনতে পারি না। আমাগো আবার ঈদ,” বলেন তিনি।
ঈদে পোশাক কেনা হবে কি না জানতে চাইলে বলেন, “কেউ জাকাতের কাপড় দিলে যদি পাই, তাহলে নতুন কাপড় পিন্দমু। নাইলে না।”