‘চূড়ায় চূড়ায় উড়িয়ে এলাম বাংলাদেশের লাল-সবুজ’

মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া লাল-সবুজ পতাকা পৃথিবীর সাত অঞ্চলের সাত সর্বোচ্চ শৃঙ্গে উড়িয়ে দিয়ে দেশে ফিরেছেন অভিযাত্রী ওয়াসফিয়া নাজরীন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2015, 04:50 AM
Updated : 1 Dec 2015, 01:12 PM

সোমবার রাতে মালয়েশিয়ার মালিন্দো এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে ক্লান্ত-শ্রান্ত ওয়াসফিয়া জানালেন, আপাতত তিনি ‘একবেলা’ ভাত খেতে চান। মেয়েদের জন্য খুলতে চান একটি স্কুল, যেখানে তারা নতুন পর্বত জয়ের স্বপ্ন দেখতে শিখবে।  

সাত অঞ্চলের সাত সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছানো প্রথম বাংলাদেশি ওয়াসফিয়াকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন তার ভাই সারওয়ার চৌধুরী, ভাবী সামিতা কায়সার, খালা ছবি রউফ ও খালু এন এ টি রউফ।

ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে বের হওয়ার পর প্রথমে তার হাতে শুভেচ্ছার ফুল তুলে দেয় অভিনেতা শহিদুল আলম সাচ্চুর শিশুকন্যা সুজাইয়া আলম। জাগো ফাউন্ডেশনের একদল কর্মীও স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

গত ১৮ নভেম্বর সকাল ১০টা ১৯ মিনিটে দুর্গম ‘মেসনার’ রুট হয়ে ওশেনিয়া অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কারস্তেনস পিরামিডে পৌঁছান ওয়াসফিয়া। পূর্ণ হয় তার সপ্ত শৃঙ্গ জয়ের অভিযান, যার সূচনা হয়েছিল ২০১১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর উদযাপন উপলক্ষে।

“মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটা শুরু করেছিলাম। তাদের দেওয়া পতাকা সাতটি সামিটে ওড়াতে পেরেছি। আমি মনে করি এটা শুধু আমার নয়, গোটা বাংলাদেশের জয়, বাংলাদেশের মানুষের জয়,” বলেন এই অভিযাত্রী।  

২০১২ সালের ২৬ মে দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্ট চূড়ায় উঠেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। অবশ্য তার আগেই জয় করেন আফ্রিকার কিলিমানজারো ও দক্ষিণ আমেরিকার আকোনকাগুয়া।

এভারেস্টের পর একে একে অ্যান্টার্কটিকার ভিনসন ম্যাসিফ, ইউরোপের মাউন্ট এলব্রুস এবং উত্তর আমেরিকার ডেনালি চূড়ায় পৌঁছান ওয়াসফিয়া আর এবার কারস্তেনস পিরামিড জয়ের মধ্য দিয়ে তার ‘সেভেন সামিটস’ পূর্ণ হয়।

ওয়াসফিয়ার কারস্তেনস অভিযান শুরু হয়েছিল গত ৭ নভেম্বর। ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রভিন্সে কারস্তেনস পর্বতমালায় ৪ হাজার ৮৮৪ মিটার উঁচু এই শৃঙ্গ স্থানীয়ভাবে পুঞ্চাক জায়া নামেও পরিচিত।

দেশে ফিরে বিমানবন্দরেই কারস্তেনস পিরামিড জয়ের অভিজ্ঞতা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, এর আগের ছয় শৃঙ্গের চেয়ে এবারের অভিযাত্রা ছিল অনেক বেশি ‘কঠিন’।

“চার বছরের একটা জার্নি। সাত সামিটের মধ্যে সবচেয়ে কষ্টকর ও দুর্গম ছিল এটা। গত তিনবছর ধরে এখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন রকম বাধার সম্মুখিন হয়েছি। যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা নিয়েই একটা বই লেখা যাবে।”

কারস্তেনস পিরামিডে পৌঁছানো কতোটা কঠিন ছিল তার বিবরণ পাওয়া যায় ওয়াসফিয়ার কথায়।

“শুনছিলাম সামিটের কাছে একটা ব্রিজ আছে। যাইয়া দেখি ওটা একটা তারের ক্রেন। ১৬ হাজার ফিটের ওপরে ওই তার ক্রস করতে হয় হেঁটে হেঁটে। আসতে-যাইতে দুইবার।”

আর সভ্যতা থেকে দূরে দুর্গম ওই পাহাড়ে কত রকম বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে, সংক্ষেপে তারও বিবরণ দিয়েছেন ওয়াসফিয়া। 

“ওখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বাস। চব্বিশ ঘণ্টাই ওরা তীর-ধনুক-বন্দুক নিয়ে পাহারা দেয়। চাপাতিও ছিল। ওখানে যেতে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুমতি নেওয়ার ব্যাপার ছিল। সেখানে মেয়েদের কোনো সিকিউরিটি নেই। প্রতিটি গ্রাম পাড়ি দিতে কি পরিমাণ ঝুঁকি নিতে হয়েছে, তা বলা কষ্টকর।”

অবশেষে দুই সপ্তাহ ট্র্যাকিংয়ের পর কারস্তেনসের বেজক্যাম্পে পৌঁছান ওয়াসফিয়ারা। এরপর ২৭ নভেম্বর ফেরার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি জানিয়ে একটি গ্রামে চব্বিশ ঘণ্টা আটকে থাকার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

“আমরা সামিট করে ফেরার সময় একটি গ্রামে একজন বৃদ্ধ মারা যায়। ওরা বিশ্বাস করে, যেহেতু ফরেনাররা এসেছে, সেহেতু মারা গেছে। আমরা তো অত বেশি টাকা নিয়ে যাই নাই। পরে সবার কাছ থেকে ১০০/২০০ ডলার করে মোট চার হাজার ডলার নিল।

“টাকা নেওয়ার পর বলল, তোমাদের কাপড়-চোপড়, জ্যাকেট, যা আছে খুলে দাও। ওরা তো বস্ত্রহীন থাকে। তখন আমরা বললাম, আমরা তো এগুলো দিতে পারব না, আরও গ্রাম ট্র্যাক করে যেতে হবে।”

ওই পাহাড়ের অর্ধেকটা পথে নিজেকে ওয়াসফিয়ার মনে হয়েছে ‘টারজান’, অর্ধেকটায় মনে হয়েছে ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’।

সাত শৃঙ্গ জয়ের আনন্দের মধ্যেও গত তিন বছরে তিনজন ঘনিষ্ঠ পর্বতারোহীকে হারানোর কথা স্মরণ করেন ওয়াসফিয়া।