অভিযোগ রয়েছে, মানসিক ভারসাম্যহীন এই নারীর নামে নিয়মিত সরকারি ভাতা এলেও তার সুচিকিৎসা হচ্ছে না। তার ছেলে মায়ের নাম আসা এ অর্থ নিজে আত্মসাত করেন।
তবে মাকে শিকলবন্দি করার কথা স্বীকার করলেও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না করার কথা অস্বীকার করেছেন তার ছেলে আব্দুল মজিদ।
মজিদ ও স্থানীয়রা জানান, ভূরুঙ্গামারীর তিলাই ইউনিয়নের বানাটারী পশ্চিমছাট গোপালপুর গ্রামের তমেজ উদ্দিনের স্ত্রী মজিরন বেগম। তমেজ উদ্দিন ভূরুঙ্গামারী উপজেলা আনাসার কামান্ডার ছিলেন।
১৯৭১ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে গোপালপুর গ্রামে হানা দেয় পাকবাহিনী। ওইদিন তাদের হাতে শহীদ হন তমেজ উদ্দিন।
পরে স্থানীয় রাজাকারদের সহয়তায় গৃহবধূ মজিরনসহ আশপাশের আরও ৫ মহিলাকে ধরে গ্রামের শুকুর কবিরাজের বাড়িতে নিয়ে নির্যাতন চালায়।
স্বাধীনতার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় তাকে নেওয়া হয় ভারতের কোচবিহার হাসপাতালে।
সুস্থ্ হয়ে দেশে ফেরার কিছুদিন পর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন মজিরন। এরপর থেকে ছেলে মজিদের সঙ্গে বাড়িতে থাকছেন তিনি।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বীরাঙ্গনা মজিরন বেগম (৬৭) একটি ঘরে ডান পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায়।
বীরাঙ্গনা ও শহীদের স্ত্রী মজিরন বেগমের তিন সন্তান। বড় মেয়ে মাজেদা বিবি, তারপর একমাত্র ছেলে আব্দুল মজিদ এবং সবার ছোট ফাতেমা বিবি।
আব্দুল মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবাকে হত্যার ঘটনার পর থেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
তিনি জানান, ১৯৮৩ সালে এরশাদের কাছে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান পান। ১৯৯৯ সালে ২০ হাজার টাকা অনুদান পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। এছাড়া শহীদ পরিবার হিসেবে তিন মাস পরপর ৪৫ হাজার টাকা পান।
মজিরনের প্রতিবেশী শাহজাহান আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যার জন্য সরকার টাকা দিচ্ছে তারই চিকিৎসা হচ্ছে না। শিকল বেঁধে অমানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
সরকার এই শহীদ পরিবারদের জন্য একটি পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, একজন মানুষ সুস্থ্ না থাকলে তার বাড়ি দিয়ে কী হবে?
মজিরনের বড় মেয়ে মাজেদা বিবি বলেন, “ভাতার টাকা মায়ের নামে আসলেও পুরো টাকা মজিদ আত্নসাৎ করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। ছেলে হয়ে মাকে শিকল বেঁধে নির্যাতন করছে। কোনো রকমের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে না মজিদ।”
ছোট মেয়ে ফাতেমা বিবিকে তার মা মজিরনের কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, মজিদ জুয়া খেলার টাকা যোগাড় করতে জাল দলিল করে তাদের জমিও বিক্রি করে দিয়েছে, তারপরেও মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি।
দুমাস আগে রান্না করা খাবার নিয়ে মায়ের কাছে গেলেও তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন ফাতেমা।
মজিরন বেগমের একমাত্র ভাই শাহজাহান আলী বলেন, “মজিদকে বলেছি আমার বোনকে খাওয়াতে, পরাতে ও চিকিৎসা করাতে না পারলে আমাকে দাও; আমি আমার বোনের সব দায়িত্ব নেব। মজিদ কথা শোনেনি।”
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মজিরন শুধু বীরাঙ্গনাই নন, তিনি শহীদের স্ত্রীও।
“তিনি দীর্ঘদিন থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন রয়েছেন। তার ছেলে তাকে অন্যায়ভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে।
“আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ফান্ডে চিকিৎসা সেবার জন্যে টাকা বরাদ্দ না থাকায় আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারিনি। তবে বিষয়টি সরকারের উপর মহল জানে। এখন তারা কী করবেন তারাই ভাল জানেন।”
আগামীতে ভাতার টাকায় মজিরন বেগমের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে এ মর্মে মজিদের কাছে মুচলেকা নেওয়া হয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন তিলাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মজিরনের ছেলে আব্দুল মজিদ।
মায়ের সেবায় আমি আমার জীবন উৎসর্গ করেছেন দাবি করে মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জমি বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা করানো হয়েছে।
মাকে শিকল কেন পরানো হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শিকল পরানো অন্যায় হলে আর পরাব না।”