যুদ্ধাপরাধী সাকার বিচার পরিক্রমা

চার দশকের বেশি সময় পর একাত্তরে হত্যা-নির্যাতনের জন্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ে সন্তোষ জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নির্যাতিত ও স্বজনহারারা।

মহিউদ্দিন ফারুকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2015, 05:33 AM
Updated : 22 Nov 2015, 10:28 AM

যুদ্ধাপরাধের বিচারকে যিনি এক সময় ‘তুড়ি মেরে’ উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়েই ঝুলতে হল ফাঁসির দড়িতে।

২০১০ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার ১৭৯৫ দিন পর পর রোববার প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একাত্তরের এই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়; অবসান হয় একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা আর ক্ষতিগ্রস্থদের চার দশকের অপেক্ষার।    

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরী এইচ এম এরশাদ সরকারের সময় ছিলেন বাংলাদেশের মন্ত্রী। বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর মত মুসলিম লীগ থেকেই রাজনীতির শুরু হলেও পরে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে তিনি বিএনপিতে আসেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একাত্তরে তিনি গণহত্যায় অংশ নেয়া ছাড়াও চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, বোয়ালখালী ও চট্টগ্রাম নগরীতে হত্যা, লুটপাট, হিন্দু বাড়ি দখল এবং তাদের দেশান্তরে বাধ্য করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন বলে এ মামলার বিচারে উঠে আসে। 

আলোচিত এই বিচারের পাঁচ বছরের ঘটনাক্রম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

২০১০

২৬ জুলাই: সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধ মামলার তদন্ত শুরু।

১৬ ডিসেম্বর: নাশকতার এক মামলায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর থেকে তিনি কারাগারেই ছিলেন।

৩০ ডিসেম্বর: ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে প্রথমবারের মত সালাউদ্দিনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

২০১১

১৪ নভেম্বর: সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ৫৫ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রের সঙ্গে ১ হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষাঙ্গিক নথিপত্রসহ ১৮টি সিডি উপস্থাপন করা হয়।

১৭ নভেম্বর: ট্রাইব্যুনাল আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়

২০১২

৪ এপ্রিল: সুনির্দিষ্ট ৭২টি ঘটনায় সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ গঠন করা হয়।

৩ ও ৭ মে : প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু।

১৪ মে: সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু।

২০১৩ সাল

১৩ জুন: প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য শেষ। তদন্ত কর্মকর্তাসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে ৪১ জন সাক্ষী এ মামলায় জবানবন্দি দেন। তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আরও চারজন সাক্ষীর দেওয়া জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল।

১৭ জুন থেকে ২৮ জুলাই: সালাউদ্দিনের সাফাই সাক্ষীদের জবানবন্দি শোনে ট্রাইব্যুনাল। সালাউদ্দিন নিজে এবং আরও তিনজন সাফাই সাক্ষ্য দেন।

২৮ জুলাই: রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু, শেষ হয় ৩১ জুলাই।   

১ আগস্ট: আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু।

১৪ আগস্ট: যুক্তিতর্ক শেষ, মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল।

১ অক্টোবর: মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ যুদ্ধাপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দেয়। প্রসিকিউশনের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।

ফাইল ছবি

 

২৯ অক্টোবর: ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেনি।

২০১৫ সাল

১৬ জুন: পেপারবুক থেকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আপিলের উপর শুনানি শুরু হয়।

৭ জুলাই: শুনানির ত্রয়োদশ দিনে উভয়পক্ষের বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হয়, ২৯ জুলাই রায়ের দিন ধার্য করে আপিল বিভাগ।

২৯ জুলাই: যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাকা চৌধুরীকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের রায়ই বহাল রাখে আপিল বিভাগ। চূড়ান্ত বিচারেও তার প্রাণদণ্ডের সিদ্ধান্ত দেয় সর্বোচ্চ আদালত। 

৩০ সেপ্টেম্বর: আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

১ অক্টোবর: রায়ের কপি ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়, জারি হয় মৃত্যুপরোয়ানা। এই দিনে কারাকর্তৃপক্ষ আসামিকে তা পড়ে শোনায়।

১৪ অক্টোবর: আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করেন সাকা চৌধুরী। পরদিন শুনানির দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

১৯ অক্টোবর: পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) শুনানিতে পাঁচ পাকিস্তানিসহ আটজনের সাফাই সাক্ষ্য নিতে আবেদন করেন সাকা চৌধুরী।

২০ অক্টোবর: চেম্বার বিচারপতি রিভিউ ও নতুন সাক্ষী নেওয়ার আবেদন শোনার জন্য ২ নভেম্বর দিন ঠিক করে দেয়।

২ নভেম্বর: সাক্ষী আনতে সাকার আবেদন আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে যায়। রিভিউ শুনানির দিন ঠিক হয় ১৭ নভেম্বর।

১৭ নভেম্বর: মামলাটি কার্যতালিকায় এলেও আইনজীবীর সময়ের আবেদনে পরদিন রিভিউ শুনানির দিন রাখে আপিল বিভাগ।

১৮ নভেম্বর: রিভিউর শুনানি শেষে সাকা চৌধুরীর আবেদন খারিজ করে সর্বোচ্চ আদালত। এর মধ্যে দিয়ে দণ্ড কার্যকরের আগে শেষ বিচারিক প্রক্রিয়াও শেষ হয়।

১৯ নভেম্বর: রিভিউ খারিজের ১৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তা পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, পড়ে শোনানো হয় যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীকে।

২১ নভেম্বর: শেষ চেষ্টা হিসেবে সাকা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। তা নাকচ হলে রাতে কারাগারে গিয়ে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন পরিবারের সদস্যরা।

রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয় যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড।