‘শুরু থেকে বিশ্বাস ছিল এই মেয়েরা পারবে’

মেয়েদের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ (দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চল) আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে এবারের আসরে বাংলাদেশ দলে নতুন মুখ ছিল ১০ জন। অভিজ্ঞতার এই ঘাটতি পুষিয়ে সাফল্য পাওয়ার গল্পটা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনালেন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। তহুরা, মনিকা, অনুচিংদের সামনের পথ চলা মৃসণ করতে দীর্ঘমেয়াদী অনুশীলনের দাবিটাও জানিয়ে রাখলেন তিনি।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2016, 12:46 PM
Updated : 3 May 2016, 12:46 PM

প্রশ্ন: মুকুট ধরে রাখার প্রস্তুতির শুরুটা কেমন ছিল। বিশেষ করে যখন জানতেন, গতবারের সেরাদের অনেকের বয়স বেশি হয়ে যাওয়ায় এবার পাবেন না।

গোলাম রব্বানী ছোটন: গতবার যখন আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম, তখন থেকেই আসলে মুকুট ধরে রাখার বিষয়টি আমাদের মাথায় ছিল। বয়সের কারণে গতবারের নির্ভরযোগ্য ১০ জন খেলোয়াড় ছিল না; এ কারণেই আমরা খুব সিরিয়াস ছিলাম। আমাদের মেয়েদের যে দুইটা টুর্নামেন্ট হয়েছিল (জেএফ কাপ ও অনূর্ধ্ব-১৪ ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ), এই দুইটা টুর্নামেন্টে আমরা বিশেষ নজর দেই। ছয়টা ভেন্যু থেকে খেলোয়াড় বাছাই করি। ১৫০ জনের জন্য সেরা ৬৭ জন নিয়ে বিকেএসপিতে অনুশীলন শুরু করি এপ্রিলের শুরুতে।

গতবারের কাদের শূন্যতা পূরণ নিয়ে আপনি বেশি চিন্তিত ছিলেন?

গোলাম রব্বানী ছোটন: অধিনায়ক কৃষ্ণা রানী, সানজিদা, শিউলি, নার্গিস, স্বপ্না, মৌসুমী-এরা এবার ছিল না। ফলে সংশয় ছিল তাদের মানের খেলোয়াড় আমরা পাব কিনা কিন্তু দেখলাম এই খেলোয়াড়দেরও মান ভালো। তারপরও সংশয় ছিল যে, এই দশ জনের কারো জাতীয় পর্যায়ে খেলার অভিজ্ঞতা নেই। ট্রেনিংয়ে তাই কিছু বিষয়ে বাড়তি নজর দিয়েছিলাম। কঠোর অনুশীলন, শৃঙ্খলার ব্যাপারে কঠোর ছিলাম। তাছাড়া বিকেএসপিতে যাওয়ায় অনুশীলনও ভালো হয়েছে। মাঠের সমস্যা ছিল না। ট্রেনিং ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে কোনো আপোশ ছিল না।

শিরোপা ধরে রাখার একটা বাড়তি চাপ ছিল। সেটা কিভাবে কাটিয়ে উঠলেন?

গোলাম রব্বানী ছোটন: অবশ্যই চাপ ছিল। কিন্তু কিরণ আপা (বাফুফের আগের মহিলা ফুটবল কমিটির কো চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার) আমাদের সার্বিক খোঁজ নিয়েছেন। শিরোপা ধরে রাখার তাগাদা দিয়েছেন; বলেছেন, আমাদের চ্যাম্পিয়ন হতেই হবে। তাছাড়া সবার সহযোগিতা থাকায় চাপটা কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে সহজ হয়েছে।

কোন পর্যায়ে এসে বিশ্বাস জন্মাতে লাগল এই মেয়েরা পারবে?

গোলাম রব্বানী ছোটন: আসলে ৬৭ জন বাছাই করার পরই মনে হয়েছিল এই মেয়েরা পারবে। ঘাটতি ছিল শুধু অভিজ্ঞতার। সিনিয়র খেলোয়াড়দের আলাদাভাবে ধন্যবাদ দিতেই হবে। তারা নিজে থেকে বিকেএসপিতে গিয়ে ম্যাচ খেলেছে; এই মেয়েদের অনুপ্রাণিত করেছে।

মেয়েদের মানসিক শক্তি বাড়ানোর জন্য স্টাফরাও কঠোর পরিশ্রম করেছে। শৃঙ্খলার ব্যাপারে আমার নির্দেশনা ছিল, অনুশীলনের এই দুই মাসে যে কেউ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে না পারে, শুধু ফুটবল নিয়ে থাকে। আবার পরিবারের অভাবটাও যেন এই ছোট ছোট মেয়েরা অনুভব না করে, সেটার জন্যও স্টাফদের অনেক কাজ করতে হয়েছে।

ভারতের বিপক্ষের প্রথম ম্যাচের পরিকল্পনা কি ছিল?

গোলাম রব্বানী ছোটন: গতবার আমরা নেপালে গিয়েছিলাম, কিন্তু এবার ছিল তাজিকিস্তানে যাওয়া; তাই ভ্রমণ ক্লান্তির ব্যাপার ছিল। সেখানে পৌঁছেই অনুশীলনে নেমেছিলাম আমরা। পরের দিন বৃষ্টি শুরু হলো, বৃষ্টির মধ্যেই এক ঘণ্টা অনুশীলন করেছি। এ কারণে দুঃশ্চিন্তাও পেয়ে বসেছিল, কেউ যদি বৃষ্টিতে অনুশীলন করায় আবার অসুস্থ হয়ে যায়। তবে কেউ অসুস্থ হয়নি।

ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে আমাদের লক্ষ্য ছিল, ওদেরকে আমারা কখনও হারাতে পারিনি। গতবার ড্র করেছি। মেয়েদের বলেছিলাম, তোমাদেরই ইতিহাস গড়তে হবে।

ভারতকে হারানোর পর তো তরতরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে গেলো আপনার দল

গোলাম রব্বানী ছোটন: আসলে এই মেয়েদের মধ্যে ক্ষুধা ছিল। তাজিকদের বিপক্ষের সেমি-ফাইনালেও আমার চাপে ছিলাম। কেননা ওরা নিজেদের মাঠে খেলবে, সবার সমর্থন পাবে। ওদের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ওদের খেলা দেখার জন্য আমি ৪০ কিমি দূরে গিয়েছিলাম।

ফাইনালে যখন ফের ভারতকে পেলেন, তখন কি মনে হচ্ছিল শিরোপা ধরে রাখাটা কেবল সময়েই ব্যাপার?

গোলাম রব্বানী ছোটন: সে রকম মনে হয়নি। তবে ভারত নয়, ফাইনালে ইরানকে চেয়েছিলাম। তবে ভারতকে যখন পেয়েই গেলাম, মেয়েদের বললাম, “আমরা ইতিহাসের খুব কাছে এসেছি। তোমরা কোনো ভুল করো না।” ওরা করেওনি। ওই দিন তহুরার দুই তিনটা শট বারে না লাগলে আমরা আরও বড় ব্যবধানে জিততাম।

আপনার দুই গোলমেশিন তহুরা-অনুচিংয়ের খেলায় কতটা মুগ্ধ আপনি?

গোলাম রব্বানী ছোটন: গতবার কৃষ্ণা, সানজিদা আর মৌসুমী ছিল আমার স্পেশাল প্লেয়ার। এবার আমার ছিল তহুরা ও অনুচিং। এই দুই জনের মধ্যে তহুরা টুর্নামেন্টে বয়স ও আকৃতির দিক থেকে সব থেকে ছোট খেলোয়াড়। কিন্তু তাকে ট্যাকটিক্যালি ও টেকনিক্যালি এমনভাবে অনুশীলন করিয়েছিলাম, তাকে কেউ আটকাতে পারেনি। সে যা ইচ্ছা তাই করেছে। তহুরা কৃষ্ণা আর আনুচিং সানজিদার জায়গা পূরণ করেছে। মনিকাও অসাধারণ করেছে।

এই মেয়েদের সামনের পথ চলাটা মসৃণ করতে কি কি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন আপনি?

গোলাম রব্বানী ছোটন: এটা আমাদের সাফল্য পাওয়ার জন্য সম্ভাবনাময় জায়গা। এখানে সাফল্য পেতে হলে যা দরকার তাই করা উচিত। দেখুন, এরা বাড়িতে গেলে অনুশীলন করবে না। পর্যাপ্ত খাবারও পাবে না। সবার আগে এই মেয়েদের পুষ্টি ও দীর্ঘমেয়াদী ট্রেনিং নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আশা করি ফেডারেশনে যারা আছেন, তারা এ দিকটা ভালোভাবে দেখবেন।

তাজিকিস্তানের কোনো মজার স্মৃতি?

গোলাম রব্বানী ছোটন: শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা তাজিকিস্তানের মানুষের সমর্থন পেয়েছি। স্টেডিয়ামে পাশে আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা এসে আমাদের খুব সমর্থন করেছে। ফাইনাল শেষে হোটেলে আসার পর হোটেলের সবাই আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছে; তারাও যেন বাংলাদেশি হয়ে গিয়েছিল।