সাত খুন: সর্বোচ্চ সাজার প্রত্যাশায় নিহতদের পরিবার

তিন বছর আগে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার রায় হতে যাচ্ছে সোমবার; স্বজন হারানো পরিবারগুলো বলছে, খুনিদের প্রাণদণ্ড হলেই বিচার পাবেন তারা।  

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2017, 09:06 AM
Updated : 15 Jan 2017, 09:06 AM

কেবল নিহতদের পরিবার নয়, নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন সোমবার সকালে কী রায় দেন, তা জানার অপেক্ষায় রয়েছে পুরো বাংলাদেশ।

সাত খুনের ঘটনায় নিহত দুইজনের পরিবারের পক্ষ থেকে দুটি আলদা মামলা হয়েছিল ২০১৪ সালে। দুই মামলার বিচার চলে একসঙ্গে; বিচারক গত ৩০ নভেম্বর চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক শুনে রায়ের দিন ঠিক করে দেন।

রায়ের আগের দিন রোববার নারায়ণগঞ্জের সাবেক প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অভিযুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তাসহ অন‌্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই তার চাওয়া।

“দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে আর কেউ এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সাহস পাবে না। আর কেউ স্বামী হারা হবে না, আর কোনো সন্তান বাবা হারা হবে না, আর কোনো মায়ের বুক খালি হবে না।

সেলিনা ইসলাম বিউটি

“আমরা আদালতের কাছে প্রত্যাশা করছি, আসামিদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়,” বলেন তিনি।

কারাগারে থাকা আসামিদের পাশাপাশি পলাতকদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান বিউটি, যিনি স্বামীর মৃত‌্যুর পর কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেও গত ডিসেম্বরের ভোটে হেরে যান।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়।

একই সময়ে একই স্থানে আরেকটি গাড়িতে থাকা নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার চালককে অপহরণ করা হয়।

ঘটনার তিন দিন পর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকায় শীতলক্ষ্যা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাত জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রত্যেকের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন; প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সেখানে চার সহযোগীসহ নজরুল লাশ মেলার পর সেলিনা ইসলাম বিউটি পাঁচজনকে অপহরণের পর হত‌্যার অভিযোগে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা করেন।

সপ্তাহখানেক পর একই অভিযোগে অপর মামলাটি করেন আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বিজয় পাল বলেন, “আমরা আমাদের স্বজনদের হারিয়েছি। যে কোনো হত্যাকাণ্ডেরই শাস্তি হওয়া উচিত। আমরা চাই, যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি- মৃত্যুদণ্ড হোক।”

একজন ‘ভালো নাগরিক’ হিসেবে চন্দন সরকারের ‘সুনাম ছিল’ মন্তব‌্য করে তার জামাতা বলেন, “যতদূর জানতে পেরেছি, তার সামনে একটা ঘটনা ঘটছিল, তিনি সেটার প্রতিবাদ করতে গিয়েই হত্যার শিকার হন।”

বিজয় বলেন, “আদালতের উচিত, এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যেন কেউ আর এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটানোর চিন্তাও করতে না পারে।”

আরেক মামলার বাদী বিউটি বলেন, মামলার কারণে তার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে।

“আগেও হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা এখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি,” বলেন তিনি।

সাত খুনের দুই মামলার তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডল।

নূর হোসেন

অভিযোগপত্রে বলা হয়, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে হত্যার এই পরিকল্পনা করেন আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে র‌্যাব সদস্যদের দিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।

মামলার আসামিদের মধ‌্যে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনের পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

ঘটনার ১৭ মাস পর মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনিসহ মোট ২৩ আসামি এ মামলায় কারাগারে রয়েছেন; পলাতক ১২ জনের মধ‌্যে আটজনই র‌্যাব সদস্য।

নারায়ণগঞ্জ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, আসামিদের মধ‌্যে ২১ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১৬৪ জনের সাক্ষ‌্য শুনেছে আদালত; যাদের মধ‌্যে ৬০ জন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।

আসামিদের মধ‌্যে র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ওই হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক ছিলেন।

তারেক সাঈদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুলতানুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণের ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা’ করেছে।

“আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে মামলার ত্রুটি বিচ্যুতি ধরে আইনগতভাবে যতটুকু সম্ভব তার পক্ষে জেরা করেছি। এখন রায়ের দিকে তাকিয়ে আছি।”

‘সুন্দর’ রায়ের প্রত্যাশা করছেন র‌্যাবের আরেক সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেনের আইনজীবী অ‌্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ ভূঁইয়াও।

তিনি বলেন, “মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ যেসব সাক্ষী হাজির করেছে, আমরা তাদের জেরা করেছি। জেরার মাধ্যমে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে সেগুলো আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। খালাস হবে- এ প্রত্যাশা নিয়েই জেরা করেছি। রায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। প্রত্যাশা করছি, একটি সুন্দর রায় ঘোষণা হবে।”