নাসিরনগরে হামলা ঠেকাতে ‘নিষ্ক্রিয়’ ছিল পুলিশ

ধর্ম অবমাননার কথা বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ও বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাটের সময় পুলিশ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন নির্যাতিতরা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2016, 05:34 PM
Updated : 2 Nov 2016, 06:05 PM

“হামলার সময় পুলিশ একেবারেই নীরব ছিল। পুলিশ হামলার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে এলে এই ঘটনা ঘটত না,” বলছেন দত্তপাড়ার বাসিন্দা রিপন দত্ত।

দত্তপাড়ার মতো হামলার শিকার ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া পাড়া, মহাকাল পাড়া, কাশিপাড়া, নমশুদ্রপাড়া, মালিপাড়া, শীলপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের একই অভিযোগ।

হামলার একদিন বাদে সোমবার প্রশাসনের উদ‌্যোগে সম্প্রীতি সমাবেশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিজিবি মোতায়েন করা হলেও আতঙ্ক কাটছে না এই হিন্দু পাড়াগুলোতে।

দত্তবাড়ির গৃহবধূ নীলিমা দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ তৎপর থাকলে এতবড় হামলার ঘটনা ঘটত না। আমরা এখনও আতঙ্কে আছি।”

গত শুক্রবার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের (৩০) ফেইসবুক পাতায় ‘ইসলামের অবমাননাকর’ একটি পোস্ট পাওয়ার কথা জানিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়।

ওইদিনই রসরাজের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়। পরদিন পুলিশ তাকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারেও পাঠায়।

রসরাজের শাস্তি দাবিতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ ব‌্যানারে রোববার বিক্ষোভ-সমাবেশের পরপরই নাসিরনগরে এবং পাশের এলাকা হবিগঞ্জের মাধবপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলে পড়ে একদল যুবক।

কয়েকশ মানুষ দফায় দফায় হামলা চালিয়ে নাসিরনগরের অন্তত ১৫টি মন্দিরে ভাংচুর করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের দেড়শ বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়।

হামলার ঘটনা তদন্তে সোমবার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে তিন সদস‌্যের একটি কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।

সোমবার সকালে দত্তবাড়ির কাজল জ্যোতি ও বারোয়ারি মন্দিরের পুরোহিত নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেছেন।

মামলায় সহস্রাধিক ব‌্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। রোববারের হামলা-ভাংচুরের পর আটক নয়জনকে এ দুই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে পুলিশ জানায়।

স্থানীয়দের নিয়ে সোমবার বিকালে প্রশাসনের উদ‌্যোগে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশের পাশাপাশি পুলিশ, র‌্যাব ও এপিবিএনের সঙ্গে বিজিবিও মোতায়েন রয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, রোববার দুপুরে রসরাজের ফাঁসির দাবিতে নাসিরনগরে বিক্ষোভ করে কয়েকশ মানুষ। প্রথমে স্থানীয়রা বিক্ষোভ শুরু করলেও পরে হেফাজতে ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সমাবেশ করে।

আহলে সুন্নাত উপজেলা সদরের আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে এবং হেফাজত কলেজ মোড়ে আলাদা সমাবেশ করে।

আহলে সুন্নাতের সমাবেশে উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম মুনিরুজ্জামান সরকার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমেদ ও ওসি আবদুল কাদের উপস্থিত ছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে তারা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বলে সাংবাদিকদের কাছে দাবি জানিয়েছেন তারা; যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা ওসি ও ইউএনওকে দায়ী করে তাদের অপসারণ চেয়েছেন।   

স্থানীয়রা জানায়, সমাবেশ চলাকালেই টুপি-পাঞ্জাবি ও গেঞ্জি পরা শত শত লোক প্রথমে দত্তবাড়ির কালীমূর্তি ভাংচুর করে। এসময় তারা দত্তবাড়ির লোকজনের উপরও হামলা চালায়।

দত্তবাড়ির গৃহবধূ নীলিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুপুরে লাঠি-সোঁটা নিয়ে কয়েকশ টুপি-গেঞ্জি পরা লোক অতর্কিতভাবে তাদের বাড়ির কালীমূর্তি ভাংচুর করে।

“মূর্তি ভাংচুরের পর তারা আমাদের উপর হামলার চেষ্টা করলে আমরা প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিই।”

একই এলাকার অমূল্য দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘরের খাটের নিচে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করেছি। হামলাকারীরা আমাকে মারধর করে ঘরে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়।”

র‌্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক মাঈন উদ্দিন বলেন, তার বাহিনীর সদস‌্যরা খবর শুনেই রওনা হন। কিন্তু তারা উপস্থিত হওয়ার আগেই হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।

হেফাজত ও আহলে সুন্নাত কোনো পক্ষই হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি।

জেলা হেফাজতের সহকারী প্রচার সম্পাদক মুফতি এনামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইসলাম এসব সমর্থন করে না। আমরা ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ঘটনার সাথে যারাই জড়িত তাদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।”

জেলা আহলে সুন্নাতের সাধারণ সম্পাদক ইসলাম উদ্দিন দুলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছি। আমাদের সমাবেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা করা হয়নি। একটি বিশেষ মহল সরকারকে বিব্রত করতেই এই হামলা চালিয়েছে।”

ঢাকায় প্রতিবাদ

বিকালে নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে সম্প্রীতি সমাবেশে জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান বলেন,

জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তে যাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা তৈরি হয়ে গেলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, “তদন্ত করে প্রশাসনের কারো বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

“আমাদের এখন মূল কাজ হলো নাসিরনগরে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা,” বলেন এসপি।