শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাইবেন না সেলিম ওসমান

নারায়ণগঞ্জের লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে তার কাছে ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সমালোচনার মুখে থাকা সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2016, 04:10 PM
Updated : 26 May 2016, 04:10 PM

দেশজুড়ে আলোচিত এই ঘটনায় নিজের অবস্থান তুলে ধরতে বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ ক্লাব কমিউনিটি সেন্টারে এক মতবিনিময় সভা করেন জাতীয় পার্টির এই সংসদ সদস্য।

সভায় সেলিম ওসমান সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন নেননি। তার বক্তব্য শেষে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করতে দাঁড়ালে তার সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে উঠেন।

সেলিম ওসমান তখন বলেন, “এটা মতবিনিময় সভা, সংবাদ সম্মেলন নয়। খোচাখুঁচি না করাই ভালো।”

সভায় নারায়ণগঞ্জ ওলামা পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, শিক্ষক সমিতি, আইনজীবী সমিতির নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

গত ১৩ মে বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে মারধর করে স্থানীয় একদল লোক। পরে তাকে কান ধরিয়ে উঠ-বস করান সেলিম ওসমান।

সেলিম ওসমান বলেন, “শ্যামল কান্তি ভক্তকে হিন্দু হিসেবে নয়, নাস্তিক হিসেবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।”

শিক্ষককে কান ধরিয়ে উঠ-বস করানোর পক্ষে নিজের যুক্তি দেখানোর পর আবার তিনিই বলেন, জনতার রোষ থেকে শ্যামল কান্তি প্রাণে রক্ষা করার জন্য তা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

“এই ঘটনার অপরাধে আমার যদি ফাঁসিও আমি প্রস্তুত আছি। তবুও আমি এই ঘটনায় দুঃখিত ও লজ্জিত।”

এই প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দিকে ইঙ্গিত করে জাতীয় পার্টির এই সংসদ সদস্য বলেন, “একজন মন্ত্রী ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকায় গিয়ে অটোরিকশার চালককে কান ধরে ওঠ-বস করান, কোনো প্রতিবাদ হয় না। ওহ, উনি মুসলমান, তাই কান ধরে উঠ-বস করানো যায়, প্রতিবাদ হয় না?”

মুসলিমরা তার পক্ষে আছে দাবি করে সেলিম ওসমান বলেন, “আমার কাছে খবর আছে কাল শুক্রবার বিভিন্ন মসজিদ থেকে বড় রকমের আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমি আপনাদের আন্দোলন নয়, মসজিদে মসজিদে দোয়া করার আহ্বান জানাচ্ছি।”

নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক অবমাননার এই ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করে।

আদালতে প্রতিবেদনে কমিটি বলছে, বিদ্যালয়টির পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক শ্যামলের বিরোধের মধ্যে তার বিরুদ্ধে কোনো একটি পক্ষ ধর্ম অবমাননার ধুয়া তুলে স্থানীয়দের প্ররোচিত করেছিল।

শিক্ষকের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির যে অভিযোগ এক শিক্ষার্থীকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছিল, ওই ছাত্রের বক্তব্য অসংলগ্ন বলে তদন্ত কমিটির কাছে মনে হয়েছে।

শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাটি প্রকাশ হওয়ার পর সারাদেশে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। শিক্ষক সংগঠনগুলো সেলিম ওসমানকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান। তার সমালোচনা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমও। 

নাসিমকে উদ্দেশ করে সেলিম ওসমান বলেন, “আমি আপনার কাছে মাফ চাইতে পারি, তার (শিক্ষক) কাছে নয়।

“আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা নারায়ণগঞ্জে আমাদের বায়তুল আমানে (পৈত্রিক বাড়ি), আপনার দাওয়াত রইল, আসেন, প্রশ্ন করেন। আমি আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেব। কিন্তু কারও কাছে ক্ষমা চাইতে বইলেন না।”

সেলিম ওসমান নির্দেশ দিচ্ছেন ওই স্কুল শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বস করতে

ঘটনার পর শিক্ষক শ্যামল কান্তির শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন দাবি করে সেলিম ওসমান বলেন, “তার পকেট খরচের জন্য ২০ হাজার টাকাও দিয়েছিলাম।

“পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি আমার কাছে তার তিন মেয়ের বিয়ের জন্য ৩০ লাখ টাকা করে ৯০ লাখ এবং তার উন্নত চিকিৎসার জন্য আরও ১০ লাখ টাকা দাবি করে। এরপর থেকে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি।”

ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সন্তান। তার দাদা খান সাহেব ওসমান আলী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন পৃষ্ঠপোষকদের একজন। সেলিমের বাবা এ কে এম শামসুজ্জোহা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।

সেলিমের ছোট ভাই এ কে এম শামীম ওসমান বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। তাদের বড় ভাই নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যু হলে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হন সেলিম।

সভায় এইচ এম এরশাদের দলের এই সংসদ সদস্য নিজের আঙুল তুলে বলেন, “আমার এই আঙুল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এই আঙুল শাহাদাতি আঙুল। এই আঙুল বঙ্গবন্ধুর আঙুল।”

নৈতিক কারণে সেলিম ওসমানকে সংসদে উপস্থিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের জবাবে সেলিম ওসমান বলেন, “আমাকে সংসদ আসতে নিষেধ করা হয়। আমার প্রশ্ন সংসদ কে চালান, স্পিকার না অন্য কেউ?”

শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির কেউ তার সঙ্গে কথা বলেনি দাবি করে তিনি বলেন, “ঘটনায় তদন্তে গঠিত কমিটি আমাকে দোষী করেছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির কেউ আমাকে প্রশ্ন করেনি। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।”

“ওই শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করালে অপরাধ হয়, হাই কোর্টের রুল হয়। কিন্তু ক্লাস রুমের ভেতরে শিক্ষক ছাত্রকে নির্যাতন করলে তার কোনো বিচার হয় না, হাই কোর্টের অবমাননা হয় না।”

শিক্ষক লাঞ্ছনার ওই ঘটনা নজরে এলে হাই কোর্ট স্বতপ্রণোদিত এক আদেশে সেলিম ওসমানসহ যাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চায়।

এ কে এম সেলিম ওসমানের মতবিনিময় সভা

পাশাপাশি ওই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাও জানতে চায় আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি আদালতে উপস্থাপন করতে তাদের প্রতিবেদন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে জমা দেয়।   

নিজে ‘রাজনীতির শিকার’ হয়েছেন দাবি করেই সেলিম ওসমান বলেন, তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

“হাই কোর্টে রুল এবং সরকারিভাবে আমার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি মরেও গেলেও দেশত্যাগ করব না।”

তিনি বলেন, “আমি অসুস্থ। আমার অপারেশন হয়েছে। গত ১২ মে আমার দেশের বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতির কারণে যেতে পারিনি।

“আমার ওষুধ নেই। আমি জমজমের পানি খেয়ে ওষুধের কাজ চালাচ্ছি। আমি আরও দুই মাস জমজমের পানি খেয়ে কাটাতে পারব।”

এর আগে সংবাদ সম্মেলন ডেকেও তা না করার বিষয়ে সেলিম ওসমান বলেন, তার দলীয় চেয়ারপার্সন এরশাদের নির্দেশে সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করেছিলেন তিনি।

এরশাদ তার ‘পাশে’ আছেন বলেও দাবি করেন সেলিম ওসমান; যদিও এরশাদের ভাই জাতীয় পার্টির কো- চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, তারা শিক্ষক লাঞ্ছনার এই ঘটনায় ‘বিব্রত’।