‘অখন সারা বছর কিলা খাইমু বুঝরাম না’

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের বিল-হাওর ডুবে যাওয়ায় চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিমাহমুদুর রহমান তারেক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 April 2016, 03:54 PM
Updated : 22 April 2016, 03:57 PM

ইতোমধ্যে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। বাকিগুলোও তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে কেউ কেউ আধাপাকা ধান কাটা শুরু করেছে।

ফসল তলিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে সময়মতো বাঁধ সংস্কার না করাকে দায়ী করেছে কৃষকরা।

আর সংস্কার কাজে গাফিলতির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দায়ী করছেন স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি।

সরজমিনে দেখা গেছে, চাষিরা নৌকা নিয়ে বারবার একই জায়গায় ঘুরছে আর পানির দিকে চেয়ে থাকছে। এই পানির নিচে চলে গেছে তাদের সারা বছরের জীবিকা।

এমনই একজন ৫০ বছর বয়সী আলী হোসেন। কাছে গিয়ে ফসলের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “১৩ কিয়ার জমিতে ধান রইছলাম। এক ধাক্কায় ১০ কিয়ার তলাইয়্যা গেল। অখন সারা বছর কিলা খাইমু বুঝরাম না।

“ভাবছিলাম পানির তল থাইক্যা কিছু ধান উঠানো যায় কি না। তাই নৌকা নিয়ে আইছিলাম। কিন্তু ধান পানির অনেক নিচে তলাইয়্যা গেছে। কাটা যাইব না।”

সময়মতো বাঁধ সংস্কার না হওয়ায় তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের আলী হোসেনের মতো সুনামগঞ্জের আরও অনেক হাওরের হাজার হাজার কৃষকের সর্বনাশ হয়েছে গত দুই সপ্তাহের টানা বর্ষণ শিলাবৃষ্টিও পাহাড়ি ঢলে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাহেদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বছর জেলায় ২ লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯ লাখ মেট্রিকটন চাল, যার দাম প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

“টানা বর্ষণ, শিলা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে ২০ হাজার ৯৪৮ হেক্টর জমির ধান। বাকি ধান দ্রুত কেটে নেওয়ার জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে।”

কিন্তু সবাই একযোগে ধান কাটতে গিয়ে লোকবল সমস্যায় পড়েছে, যার কোনো সমাধান পাচ্ছে না চাষিরা।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরের কৃষক আসকর আলী বলেন, “ধান কাটার জন্য শ্রমিক খুঁজে পাচ্ছি না। দৈনিক ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে নিজেই ধান কাটায় লেগে গেছি।”

শনির হাওরের কৃষক মাহমুদ উন নবী বলেন, “সোমবার থেকে শনির হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। অধিকাংশ জমি এখন পানির নিচে। ক্ষেতের ধান এখনও আধা পাকা। তলিয়ে যাবার ভয়ে কাটা শুরু করেছি।”

ফসল তলিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে সময়মতো বাঁধ সংস্কার না করাকে দায়ী করেছে কৃষকরা।

জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়া হাওরের কৃষক আবেদ মাহমুদ বলেন, “আমাদের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে দেরিতে। শেষও হয়েছে হাওরে পানি আসার পরে। যথাসময়ে কাজ শুরু ও শেষ হলে ফসল ডুবত না।”

জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান মুক্তাদির আহমদ বলেন, “সঠিক সময় বাঁধ সংস্কার না করায় এ উপজেলার সবচেয়ে বড় নলুয়ার হাওর চোখের সামনেই বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে।”

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, “পাউবোর অবহেলা আর ঠিকাদারদের অনিয়মের কারণে বাঁধ ভেঙে ফসল ডুবছে। ফসলহানির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন বলেন, এবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে জেলার ৪০টি হাওরে ৪৩ কোটি টাকার বাঁধ সংস্কার হয়েছে। ৩১ মার্চের মধ্যে ঠিকাদারদের কাজ শেষ করার কথা ছিল।

“বারবার সর্তক করার পরও অনেক হাওরে ঠিকাদার সময়মতো কাজ শেষ করেনি। এ কারণে অনেক হাওরে বাঁধ ভেঙে বোরো ফসল তলিয়ে গেছে।”

দায়িত্বে অবহেলার দায়ে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান। তার বিরুদ্ধে সঠিকভাবে তদারক না করার অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন।

সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-জামালগঞ্জ-ধরমপাশা) আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হাসেন রতন বলেন, “ফসল হারিয়ে হাওরের কৃষকরা এখন অসহায়। চারদিকে ফসল হারানোর হাহাকার।

ফসল রক্ষা বাঁধ ভাঙার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা দায়ী। তাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা ও কমিশন খাওয়ার কারণে হাওরগুলোয় ভালোভাবে বাঁধ সংস্কার হয়নি।”

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. জামাল উদ্দিন বলেন, “আমি ফসলের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছি। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে অবহিত করব। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তদন্ত সাপেক্ষ অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”