‘সাহায্য ছাড়াও বাংলাদেশ এগোবে’

বিদেশি সাহায্য ছাড়াও এখন বাংলাদেশ এগোতে পারবে বলে মনে করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী। তবে প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায়তার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2015, 04:44 PM
Updated : 24 May 2015, 11:24 AM

শনিবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ‘পলিটিক্স অব ফরেন এইড’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় এ কথা বলেন তিনি।

ঢাবি’র এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের ‘ইস্যুস অ্যান্ড প্রবলেমস অব ডেভেলপমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া’ কোর্সের অংশ হিসেবে আমন্ত্রিত বক্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক বৈদেশিক সহায়তার রাজনীতি সংক্রান্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।

বিভাগের অধ্যাপক ও কোর্স কো-অর্ডিনেটর ড. সাদেকা হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর সম্পাদককে পরিচয় করিয়ে দেন।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “বাংলাদেশ নানাভাবে বৈদেশিক সহায়তা ছাড়াই সামনে এগোতে পারে। তবে সহজ শর্তে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়া গেলে তা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিয়ন্ত্রক অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যবহার করা যেতে পারে।”

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা অথবা প্রযুক্তি বিনিময় খাতও আসতে পারে। যেমন রাজধানীতে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের বিষয় রয়েছে। তাতে জাপানের সহায়তা একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

“একটা সময় ছিল যখন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পুরো অর্থই আসতো বৈদেশিক সহায়তা থেকে; তখন যেকোনো শর্তই মেনে নিতে হতো। সেই দিন নেই।”

তিনি বলেন, “কৃষি ভর্তুকি বন্ধের শর্তে আমাদের কোনো বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”

রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আধুনিকায়নেরও সুপারিশ করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রধান সম্পাদক।

শুক্রবার থানায় গিয়ে ভুক্তভোগী এক নারীর পুলিশের সহায়তা পেতে বিড়ম্বনার বিষয়টি তুলে ধরে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের সুপারিশ করেন তিনি।

পুলিশ সংস্কার এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন করে পদোন্নতির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার সুপারিশ করেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

তার মতে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর দুর্নীতিও কোনো অংশে কম নয়।

এক্ষেত্রে বৈদেশিক সহায়তা নেওয়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বা এনজিওর কার্যক্রম তদারকির বিষয়ে জোর দেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রধান সম্পাদক।

শিক্ষাখাতে বৈদেশিক সহায়তা সুফল আনবে অভিমত দিয়ে তিনি বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষার অর্থায়নও তদারকি করতে হবে।

এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতির উদাহরণ দেন তিনি।

ঢাবি সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে বেলা সাড়ে ৩টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার বক্তৃতা পর্বে বিভাগের শিক্ষক ও শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।

অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন ও প্রভাষক মো. মুনতাসীর মাসুম এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

বিদেশি সাহায্য নিয়ে রাজনীতি

উপনিবেশিক শাসনের কথা তুলে ধরে তৌফিক ইমরোজ খালিদী জানান, আর্থিক সহায়তার যাত্রা শুরু সেই সময় থেকেই, যখন বাণিজ্য শুরু হয়। বাণিজ্য প্রসারে সহায়তার রাজনীতিও চলে তখন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বৈদেশিক সাহায্যের ধরন পরিবর্তিত হতে শুরু করে। সহায়তা প্রক্রিয়ায় একটি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শুরু হয় সে সময় থেকেই। এরপরেই বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ  প্রতিষ্ঠানের জন্ম।

“দুই ভাগে বিভক্ত পৃথিবীতে তখন শুরু হয় ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতা। যাদের কারণে বিশ্ব-অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল তারাই তা পুনরুদ্ধারে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। সে সময় সহায়তা দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা হলো জাপান, পশ্চিম জার্মানিকে।”

তিনি জানান, স্নায়ু যুদ্ধের চার দশকে বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে দাতাসংস্থার পক্ষ থেকে অনেক ধরনের কথাও শুনতে হয়েছে।

“শিল্পায়নের সময়কালে সাহায্যের দিকও পাল্টালো। জাতিসংঘের দিক থেকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হলো; বিশেষ করে ইউনিসেফ, রোগ নির্মূলে ডব্লিউএইচও’র সহায়তা।

“ব্রেটন উডস সম্মেলনের অর্থাৎ বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর নতুন উপলব্ধি এলো। প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তা করা উচিত ছিল। তারা স্বীকার করলো- ‘আমরা ভুল করেছি, শুধু প্রকল্পেই টাকা ঢেলেছি। এখন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য অর্থায়ন করতে হবে’।”

সেকাল-একাল

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর সম্পাদক বলেন, এখন আর বাংলাদেশ সাহায্য নির্ভর দেশ নেই। বৈশ্বিকভাবে ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে এ নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। রাজনীতি, ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিষয় রয়েছে বৈদেশিক সহায়তায়।

“বৈদেশিক সহায়তার রাজনৈতিক চরিত্র থেকেই গেছে। এক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা- দুই পক্ষেরই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এ জন্য অবকাঠামো খাতের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহার করতে হবে।”

বৈদেশিক সাহায্যের রাজনীতিকে জটিল আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, আধুনিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা এ নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তুলেছেন। অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা কতটুকু, কোন খাতে তা ব্যয় হবে, স্বচ্ছ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে কি না তা বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ সহায়তা কতটা রাজনৈতিক হওয়া উচিত তা নিয়েও অনেক আলোচনা রয়েছে।

এরশাদ শাসনামলের সময়কার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ওই সময়ে দেশের অর্থনীতিতে সহায়তা আনতে পারাটাকেই বড় করে দেখানো হয়েছে। রাজস্ব বাজেটে উদ্বৃত্ত দেখানোর প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল। সেই সব বৈদেশিক সাহায্য ছিল মূলত ঋণ। আমরা এখনো সেই ঋণের সুদ শোধ করে যাচ্ছি। যে কারণে বাংলাদেশের বাজেটের বড় অংশ ব্যয় হয় এইসব ঋণের সুদ পরিশোধে।”

দেশের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা, যমুনা সেতু ও পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রধান সম্পাদক ১৯৮৮ সালের বন্যার পর নেওয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প সংক্রান্ত গবেষণা ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান বা ফ্যাপের কথা তুলে ধরে বলেন, “সেসময় প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থ এসেছিল। শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল কোন প্রকল্প নেয়া হবে নাকি হবে না তা ঠিক করতে। সেসময় বিদেশিরা যাকে তাকে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নেতৃত্ব দিত। একটি উদাহরণ দিতে পারি, এমনও হয়েছে হাইড্রোলজি প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছেন পশু চিকিৎসক।”

সহায়তার কার্যকারিতা প্রসঙ্গে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “টাকা কত নিচ্ছি তা বড় বিষয় নয়, এটার কোয়ালিটি কি তা নিশ্চিত করতে হবে। টাকা নিয়ে কী করবো-বাগান করবো না স্কুল বানাবো; ক্যান্টনমেন্ট বানাবো, নাকি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাগার বানাবো- এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে নিতে হবে।”

যমুনা সেতু নির্মাণে প্রকল্প নিয়ে সে সময়কার নানা দিক তুলে ধরে তিনি  বলেন, শর্ত মেনেই সহায়তা নিতে হয়েছে।

“বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক ‘কম্প্রোমাইজ’ করা হয়েছে। দুর্নীতি ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার অনেক অভিযোগ আছে। নদী শাসনের ক্ষেত্রে কাজের মান নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ আছে। ফলে ভবিষ্যতে এমন হতে পারে যে, এখানে আর নদী থাকবে না; ব্রিজটি শুকনো মাটির উপরই দাঁড়িয়ে থাকবে।”

‘দরকার সুশাসন’

সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পক্ষে মাহবুব হোসেন, শাহীন আহমেদ, আজাদুর রহমান, কাজী নুশরাত আনোয়ার, নাজমুন নাহার নিশাত, ইকবাল হোসেন, সজিত হাসনাইন, সাইফুল ইসলামসহ অন্তত ২০ জন প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। উপস্থিত শিক্ষকদের কেউ কেউও এতে অংশ নেন।

তাদের প্রশ্নের জবাবে তৌফিক খালিদী বলেন, “সামরিক শাসন বা অগণতান্ত্রিক শাসনের সময় বিভিন্ন সমস্যা থাকে। সেই ধরনের সমস্যা এখন আর নেই। এখন বিদেশি সাহায্য ছাড়াই চলা সম্ভব। তারপরও সাহায্য পেলে তা সঠিক কাজে লাগাতে হবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা।”

কারিগরি সহায়তা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা, প্রযুক্তি বিনিময়, বিচার বিভাগ, পুলিশ, শিক্ষা ও জনপ্রশাসনকে দক্ষ করা, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার বিষয়ে জোর দেন তিনি।

“যে কোনো কিছুর আগে গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এই জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।”