বাজেট নিয়ে বিপরীত অবস্থানে এরশাদ-রওশন

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সাধারণ আলোচনায় ভিন্ন অবস্থান নিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও তার স্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2017, 02:49 PM
Updated : 28 June 2017, 03:36 PM

বুধবার বাজেট আলোচনায় এরশাদ অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করলেও রওশন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

এরশাদ সংসদে বলেন, “অর্থমন্ত্রী বলেছেন উনার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেট। আমি গ্রামে ঘুরি। রংপুরে গিয়েছিলাম। লোকজন বলে ৫০ টাকার চাল খাই। বাজেটে দাম আরও বাড়বে খাব কি। আমি বলেছি প্রধানমন্ত্রী দেখবেন। আর মনে মনে বলেছি, প্রধানমন্ত্রী আমার সাথে দেখা করেন না। কি করে বলব।

“অর্থমন্ত্রীর কাছে শ্রেষ্ঠ বাজেট, জনগণের কাছে নিকৃষ্ট বাজেট। উনার কাছে শ্রেষ্ঠ হতে পারে। কিছু বিষয় সমালোচনা করতেই হচ্ছে; ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। উনি বললেন, বেস্ট অব বাজেট আর জনগণ বলে, ওয়েস্ট অব বাজেট।”

তিনি বলেন, “দুঃসহ বাজেট বলেছে রিকশাওয়ালা, ক্ষেতমজুর। মহা আতঙ্কে আছে। তারা বলে, আলোর সন্ধান পাচ্ছে না। এই বাজেটে ঘাটতি এক লাখ ১২ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। অবাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাজেট দিয়েছেন।”

আর্থিক খাতে অনিয়মের প্রসঙ্গে এরশাদ বলেন, “ব্যাংক খাতে লুটপাট হচ্ছে। বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। কেন তাদের নাম প্রকাশ করা হয় না? তারা কি এতই শক্তিশালী? সরকারের চেয়েও? শেয়ার মার্কেট ও মানি মার্কেট ক্যান্সারে আক্রান্ত। ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।

“বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পাওয়ায় কর্মসংস্থান কমেছে। কত কর্মসংস্থান হয়েছে তার হিসাব দেয় নাই। বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান ছাড়া প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। কিভাবে ৭ দশমিক চার শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবেন? শেয়ার বাজার-মানি মার্কেট টালমাটাল। বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। কেন কিছু বলেন নাই? বেসিক ব্যাংকের অবস্থা করুণ। কেন নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না?”

এরশাদ বলেন, “রিজার্ভ থেকে টাকা চুরি হয়েছে। অনন্য ঘটনা। কারও নাম জানতে পারেননি। তারা কি ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। এর চেয়ে দুঃখজনক কি হতে পারে? অর্থমন্ত্রীর কি সুশাসনের অভাব। ব্যাংক খাত লুটপাটকারীদের নাম প্রকাশ করুন। চিহ্নিত করুন।

“আমাদের দেশে শেয়ার মার্কেটের অর্থ হচ্ছে লোপটের প্রাণ কেন্দ্র। আমি আর্তনাদ শুনেছি। প্রধানমন্ত্রী মা। জানি তাদের দুঃখে এগিয়ে আসবে। জানি না পেরেছেন কীনা। শেয়ার বাজার শক্তিশালী করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিজ ডিনাইড। কিন্তু জাস্টিজ ওয়াজ বিট্রেইড।”

এরশাদ সিগারেটের ওপর শতাভাগ কর আরোপের দাবি করে বিড়িতে দুই শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব দেন।

বক্তব্য দিতে উঠে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, “দরিদ্র বান্ধব বাজেট পাব বলে আশা করছি। আমার মনে হয় সর্বকালের সর্ববৃহৎ বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। জাতিকে অনেক স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। এতবড় বাজেট আমাদের চিন্তা-চেতনায় আসে না। এর বাস্তবায়ন গতি দ্রুত হতে হবে। সমৃদ্ধশালী দেশ হতে হবে।

বাজেটের ওপর এবারই প্রথম সংসদে ভালো আলোচনা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন রওশন।

“অনেকে বাজেটকে বলেছে কল্পনার ফানুস। অনেকে বলেছে অর্থমন্ত্রীর বিচার হওয়া উচিত। আমি অর্থমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ উনি বাজেট দিয়েছেন বলেই এই আলোচনা হয়েছে। জনগণের কিছু দাবি আছে। সেগুলো দেখবেন। শেখ সেলিম বলেছেন, অর্থমন্ত্রী কেন এত বকবক করেন। আমার ভালো লেগেছে। এবারই ভালো আলোচনা হয়েছে।”

এরশাদ বিড়ির ওপর ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব দিলেও রওশন বিড়ি কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানান। তার এই দাবি জানানোর সময় সংসদে হাসির রোল পড়ে। পাশে বসা এরশাদকেও হাসতে দেখা যায়।

রওশন বলেন, “বিড়ি কারখানাতে ছোট ছোট বাচ্চারা কাজ করছে। কারণ অভাব। শিশু শ্রমতো বন্ধ। বিড়ি বন্ধ না করলে হবে না। আশা করি এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন। ছোট ছোট কটেজ ইন্ডাস্ট্রি করে দেন।”

তিনি বলেন, “রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্র দেখিয়েছেন... গত বাজেটেও অর্থমন্ত্রীর বড় চিন্তা ছিলে আদায় নিয়ে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরেছে। আবগারি শুল্ক ধরেছে। কর্পোরেট ট্যাক্স ধরেছে। রাজস্ব আদায় হবে। লোকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভ্যাট আদায় সমীচীন হবে না। চিন্তা করতে হবে।

“অর্থমন্ত্রী ভালো করেই জানেন এডিপির বরাদ্দের পুরো টাকা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না। তাড়াহুড়ো করে বরাদ্দ নেয় কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। যা বরাদ্দ দেওয়া হয় তা যেন জনগণের কাজে লাগে সেটা দেখতে হবে “

ভ্যাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ভ্যাটের বিষয় নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে দুশ্চিন্তা আছে। এটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। বিশেষভাবে অনুরোধ করব এটা নিয়ে চিন্তা করবেন। আবগারি শুল্ক যেটা আছে... আমার মনে হয় এক লাখ টাকা যার আছে সে বিত্তশালী এটা ঠিক নয়। এক লাখ টাকা কোনো টাকা নয়। এটা আবার চিন্তা করে দেখবেন।”

‘আমার কোন দোষ ছিলো না’

এদিকে বাজেট আলোচনার শুরুতে এরশাদ দাবি করেন, রাষ্ট্র ক্ষমতা নেওয়ার ক্ষেত্রে তার নিজের কোনো দোষ ছিল না।

তিনি বলেন, “আমার কোনো দোষ ছিল না। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে আমাকে ক্ষমতা নিতে হয়েছিল। আমি নির্বাচন দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি।”

নিজের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এরশাদ বলেন, “বিচারপতি সাত্তার নির্বাচন করবেন। আমি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলাম, নির্বাচনের জন্য তাকে সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু এক বছরের মাথায় তিনি বললেন, আমার মন্ত্রিসভার সকল সদস্য দুর্নীতি পরায়ণ। আমি দেশ পরিচালনায় অপারগ। সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাই। আমরা প্রস্তুত ছিলাম না, কারণ দেশ পরিচালনা করা সহজ ব্যাপার নয়। এটা আমি উপলব্ধি করি। আমি ক্ষমতা নিতে চাইনি। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না, ক্ষমতা নিতে হয়েছিল। বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল।”

ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেওয়া নিজের প্রতিশ্রুতির কথ তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি সেদিন বলেছিলাম- আমি নির্বাচন দিয়ে শৃঙ্খলা ফিরে আসার পর আবার ব্যারাকে ফিরে যাব। আমি আমার কথা রেখেছিলাম। ১৯৮৪ সালে নির্বাচন দিয়েছিলাম। ওই নির্বাচনে সকলে অংশগ্রহণ করলে আমি ব্যারাকে ফিরে যেতে পারতাম। ‍দুঃখের বিষয়ে তখন বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। এখানে আছেন মেনন সাহেব, ইনু সাহেবও অংশগ্রহণ করেননি। এর ফলশ্রুতিতে আমাকে ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি সৃষ্টি করতে হয়েছিল।

“আমাকে মাঝে মাঝে বলা হয় স্বৈরাচার। আমার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল।দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে আমাকে ক্ষমতা নিতে হয়েছিল। কিন্তু এ জন্য আমাকে ছয়টি বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।”