তত্ত্বাবধায়ক ছাড়লেন খালেদা

চার বছরের কট্টর অবস্থান থেকে দৃশ্যত সরে এসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক না হোক, যে কোনো নামে একটি ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচন চায় তার দল।

সুমন মাহমুদ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2015, 03:28 PM
Updated : 26 July 2015, 04:48 AM

শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে নিজের কার্যালয়ে এক সভায় বিএনপি প্রধান বলেছেন, “আমি বলব না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। যে নামেই হোক একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আমরা দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই।”

বিএনপিপন্থি নাগরিক সমাজের একজন নেতা খালেদার এই বক্তব্যকে ‘সংকট থেকে উত্তরণে ম্যাডামের এক কদম অগ্রসর’ হওয়া বলে মন্তব্য করেছেন।

একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিএনপি প্রধানের বক্তব্যকে বাস্তবোচিত আখ্যা দিয়ে একে বিলম্বিত বোধোদয় বলে মন্তব্য করেছেন।

শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে গুলশানে নিজের কার্যালয়ে মতবিনিময়কালে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী খালেদা সরকারের সঙ্গে আপোষরফারও ইঙ্গিত দেন।

তিনি বলেন, “কেন আমাদের একে অপরের মুখ দেখাদেখি হবে না? কেন আমরা বসব না? আমরা একসঙ্গে বসেই সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলাম।”

১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ হয়। এরপর থেকে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে এ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে পরবর্তী সরকার গঠিত হয়।

দুটি নির্বাচন এভাবে হওয়ার পর ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

২০১১ সালের ১০ মে এক রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। পরের মাসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে সরকার।

শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিরোধিতা করে আসা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি তা ঠেকানোর আন্দোলনে নামে।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি জোটের ওই আন্দোলন এবং নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে তাদের তিন মাসের অবরোধে নাশকতায় অন্তত দুইশ মানুষের প্রাণহানি হয়।

৫ জানুয়ারির ভোট বর্জন করে আসা বিএনপি বর্তমান সরকারকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সরকারের মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হবে।

আইনজীবীদের সভায় দ্রুত নির্বাচনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে খালেদা জিয়া বলেন, “পুলিশ-র‌্যাব প্রশাসন দিয়ে জোর করে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা যায় না। এ্রর পরিণতি হয় ভয়াবহ। আমরা তা চাই না। তাই সরকারকে বলব, এখনও সময় আছে, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।”

গত এপ্রিলে ডিআরইউতে এক আলোচনা সভায় এমাজউদ্দিন আহমেদ (মাঝে)

এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসাকে সমঝোতার দিকে খালেদা জিয়ার এক পা এগোনো হিসেবে দেখছেন বিএনপির পরামর্শক হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক এমাজউদ্দিন আহমেদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে এ ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে তাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলার উপায় নেই।

“এই অগণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলে জাতি যে ক্রাইসিসে পড়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য (এই দাবির মাধ্যমে) ম্যাডাম এক কদম এগোলেন। মূল কথা হল- একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতি একটি ফ্রি, ফেয়ার, ইনক্লুসিভ ইলেকশন দেখতে চায়। সোজা কথা হল- সুষ্ঠু, অবাধ ও সব দলের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সকালের খবর পত্রিকার সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “আমি বলব, বিএনপি যদি এই দাবিটা পুনর্বিবেচনা করে থাকে, তাহলে সেটা বাস্তবোচিতই হয়েছে। বিলম্বে হলেও তারা বাস্তবটা অনুভব করতে পারছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে তিনি বলেন, “১৯৯৫-৯৬ সালে যখন মূলে আওয়ামী লীগের তরফে এই দাবি উঠে, তখন বিএনপি এর বিরুদ্ধে ছিল। সেই সময় আওয়ামী লীগ এই দাবি তোলে এবং বিএনপি ভেহেমেন্টলি এর বিরুদ্ধে ছিল। খালেদাতো বলছিলেন, ‘পাগল আর শিশু ছাড়া কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হয় না। উনারা এটার বিরুদ্ধে ছিলেন।”

তিনি আরও বলেন, “পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমরা তিনটা নির্বাচন করলাম, সেখানে রাজনৈতিক নেতারাই এই সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। রাজনীতিবিদরা এই ব্যবস্থা আনল, কিন্তু যখন নিজেরা নির্বাচনে না জেতে তখন এটার বিরোধিতাই করে।

“সর্বশেষ খালেদা জিয়া বিচারকদের বয়স পরিবর্তনের মাধ্যমে সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। যে আন্দোলন খালেদা জিয়া ২০১৩-১৪ সালে করলেন, সেখানে জনসাধারণকে নামাতে পারেননি।”

বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন-এই দাবিতে ব্যাপকভাবে জনসাধারণ, বিএনপি দাবি করতে পারে, সমর্থন করেছে, কিন্তু আন্দোলনেতো মানুষ রাস্তায় নামেনি। পরে বিএনপির নেতাকর্মীরাও নামেনি এবং আন্দোলনটা সন্ত্রাসের লাইনে চলে গেল। এর থেকে প্রমাণিত হয়, এটা এমন দাবি না, যার জন্য জনগণ বড় আন্দোলন গড়ে তুলবে বা প্রাণ দিতে পারে।”

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তার প্রস্তাব, “নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচন কমিশনটাকে শক্তিশালী করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, সরকারের, প্রশাসনযন্ত্রের নিরপেক্ষ থাকা, রাজনীতিবিদদের সঠিক আচরণবিধি মেনে চলা-এগুলো হলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সুলাইমান নিলয় ও সালাউদ্দীন প্রীতম।]