তুষ্ট করার নীতি বিপদ ডেকে আনতে পারে

. আবদুল মান্নানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2013, 10:23 AM
Updated : 9 April 2013, 12:14 PM
ইসলামের হেফাজতকারীর লেবাসে গত শনিবার রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থল মতিঝিলে সমাবেশ করেছে সারাদেশ থেকে আসা লক্ষাধিক কওমী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরকর্মী। ওরা এসেছিল হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে। সমাবেশের আগে হেফাজত বলেছিল যে, তারা একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু দিন শেষে ফিরে গেল একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে। এ ব্যাপারে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি। তবে সমাবেশ সফলভাবে শেষ করার জন্য সরকারেরও যথেষ্ট সহযোগিতা ছিল।

রাজনৈতিক দলগুলো হেফাজতিদের সাহায্য করেছে ভিন্ন ভিন্ন কারণে। জামায়াত-বিএনপি জোট গত তিন বছর ধরে চেষ্টা করছে যে কোনো উপায়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিতে। জামায়াত চাচ্ছে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের যে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার চলছে সে বিচার বানচাল করে তাদের মুক্ত করতে। দল দুটি তাদের উদ্দেশ্য সাধনে বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। জানমালের ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করেছে। কিন্তু তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি।

না পারার প্রধান কারণ তারা জনগণকে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। এখন কৌশলে তারা কওমী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের শরণাপন্ন হয়েছে। এখানে তাদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির একাত্মতা ঘোষণার কারণ হচ্ছে স্রেফ ফেরেববাজি। এটি করে তারা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বাড়তি সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে।

ওদিকে সরকারও হেফাজতিদের সমাবেশ আয়োজনে সাহায্য করেছে। কারণ সরকার জানে, গত চল্লিশ বছরে এ ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠীটি ফুলে-ফেঁপে বেশ বড় হয়েছে, এবং এ মুহূর্তে অনেকের মতে তাদের সংখ্যা পঞ্চাশ লাখ পর্যন্ত হতে পারে। তারা আর কিছু না পারুক, দেশকে এক চরম নৈরাজ্যমূলক অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে। এদের একটি বিরাট অংশ মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক। পারলে আজই তারা দেশে তালেবানি শাসন কায়েম করে। সুযোগ পেলেই যে তারা এটা করবে সে রকম একটি ঘোষণাও দিয়েছে তারা। তাদের স্লোগান হচ্ছে- ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’।

শনিবার সারাদিন পুরো দেশে এক ধরনের উৎকণ্ঠা ছিল কী-হয় কী-হয় বলে। শেষ পর্যন্ত কিছুটা হলেও শান্তিপূর্ণভাবে দিনের কর্মসূচি হেফাজত-গং পালন করেছে যদিও তাদের একটি অংশ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও ড. মুনতাসির মামুনের উপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেছে, সাংবাদিকদের উপর চড়াও হয়েছে এবং গণজাগরণ মঞ্চের উপরও হামলা করার চেষ্টা করেছে। হেফাজত ইসলামকে পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়েছেন, কারণ তাঁর ভাষায়, ‘তারা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের সমাবেশ শেষ করেছ‘।

তবে অবাক বিষয় হচ্ছে যে, হেফাজত পার্টি তাদের যে ১৩ দফা দাবি পেশ করেছে সেগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে বলে সরকার আশ্বাসও দিয়েছেন। কী কারণে মহাজোট সরকার হেফাজতে ইসলামের মধ্যযুগীয় দাবিদাওয়া পূরণ করার কথা চিন্তা করছে তা বোধগম্য নয়। তাদের ১৩ দফা দাবি হচ্ছে অন্ধকার যুগে ফিরে যাওয়ার একটি উৎকৃষ্ট রেসিপি। তা যদি তারা করতে চায় তাহলে তাদের উচিত হবে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। জনগণ যদি তাদের সমর্থন করে তাহলে তারা সরকার গঠন করে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারে। অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করা আরেক ধরনের ফেরেববাজি।

তবে এ মুহূর্তে সরকার যেটি করছে তা হল, হেফাজতকে সম্পূর্ণভাবে একধরনের তোষামোদ বা তুষ্ট করা, ইংরেজিতে একে বলে Appeasement, রাজনীতিতে তুষ্ট করার সংষ্কৃতি খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। তার কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরতে চাই।

গত শতকের ত্রিশের দশকে জার্মানির হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্পাদিত সকল চুক্তি বাতিল করে তাদের হারানো সাম্রাজ্য জবরদখল করা শুরু করেন। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, মিত্রবাহিনী, বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তার এ আগ্রাসী ভূমিকায় বাধা দেবে।

কিন্তু সে সময় ফ্রান্সের সে মুরোদ ছিল না। আর ব্রিটেনের নেতৃত্ব ছিল একজন মেরুদণ্ডহীন প্রধানমন্ত্রী নেভিল চ্যাম্বারলীনের হাতে। চ্যাম্বারলীনের নীতি ছিল- হিটলার ইউরোপে যা খুশি করুন, ব্রিটেনে হাত না দিলেই হল। শুধু চ্যাম্বারলীন নন, ব্রিটেনের পুরো মন্ত্রিসভাই তখন হিটলারের সামনে নতজানু। তাদের একটাই কথা, ‘আমরা তো ভালো এবং নিরাপদেই আছি’। অযথা হিটলারের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে আমাদের কী লাভ?

হিটলারও ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব বুঝতে পেরে একটির পর একটি ইউরোপীয় দেশ দখল করার দিকে নজর দিলেন। একসময় হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন চ্যাম্বারলীন। হিটলার তাঁকে জানালেন যে, তিনি যুদ্ধ করে কোনো দেশ দখল করবেন না। ফিরে এসে চ্যাম্বারলীন তাঁর সভা পরিষদদের জানালেন, ‘এ লোকটার (হিটলার) উপর আস্থা রাখা যায়। সে কথা দিয়েছ‘।

হিটলার সম্পর্কে চ্যাম্বারলীনের এটি ছিল এক চরম আত্মঘাতী উক্তি। জার্মান নেতা পরে অনেকটা বিনা বাধায় ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ দখল করে নিয়েছিলেন। পরের ইতিহাস সকলের জানা।

আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে জামায়াতে ইসলামী দাবি জানাল কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে। তখন রাজনৈতিকভাবে দূর্বল ভুট্টো তাদের দাবি মেনে নিলেন। তারপর তারা দাবি তুলল তাদের সকল নেতা-কর্মীকে জেল থেকে মুক্তি দিতে হবে। সে দাবিও মেনে নেয়া হল।

এভাবেই পাকিস্তান ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। ১৯৭৭ সনে সাধারণ নির্বাচনে ভুট্টোর পিপলস পার্টি জামায়াতসহ অন্যান্য বিরোধী দলের মোর্চা পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের (পিএনএ) বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে বিজয়ী হল। পিএনএ ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলল। আন্দোলন রাজপথে গড়াল। পিএনএ নতুন নির্বাচন চায়। ভুট্টো তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন।

১৯৭৭ সালের ৪ জুলাই ভুট্টো পিএনএর’র সঙ্গে নতুন নির্বাচনের চুক্তি করলেন। সেদিন মধ্যরাতের পর জেনারেল জিয়াউল হকের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনি ক্ষমতা দখল করল। গ্রেফতার হলেন ভুট্টো। হুকুমের আসামী হিসেবে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এক তামাশাপূর্ণ বিচারের মাধ্যমে দু’বছর পর তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হল।

ভুট্টো ও চ্যাম্বারলীন দুজনই প্রতিপক্ষের কূটচাল বুঝতে না পেরে যৌক্তিক কারণ ছাড়া তাদের তুষ্ট করতে চেষ্টা করেছিলেন। তারা প্রতিপক্ষের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে দেশ শাসন শুরু করতে না করতেই তাঁর ও দেশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চলে। অতি-বাম আর অতি-ডান একজোট হয়ে নানা অজুহাতে আন্দোলনের নামে সারা দেশে একযোগে নাশকাতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে দিল। আজ এ পাটের গুদামে আগুন তো কাল ওই কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ। ঠিক বর্তমানে যেমন জামায়াত-শিবির-বিএনপি’র সন্ত্রাসীরা শুরু করেছে। তারপর হঠাৎ শুরু হল মওলানা ভাসানীর ‘মুসলিম বাংলা’ আন্দোলন। একটাই মতলব, বঙ্গবন্ধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলে তাঁকে উৎখাত করা।

এ সময় পাকিস্তান সরকারও এ সব কাজে সহায়তা করার জন্য মাহমুদ আলী নামক একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিল। দেশের বাইরে জামায়াতের আমির গোলাম আযম তখন পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন করছেন। দেশে এক চরম নৈরাজ্য। বর্তমানের নৈরাজ্য অবশ্য সে নৈরাজ্যকেও হার মানায়। বঙ্গবন্ধু অনেকটা বাধ্য হয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এলেন। তাঁর শত্রুরা এ ঘটনার পর তাঁকে বেশিদিন বাঁচতে দেয়নি।

সম্প্রতি বিএনপি’র নীতি নির্ধারক ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, সরকার দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পাঁয়তারা করছে। সরকার তো খামোখাই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে না। দেশের পরিস্থিতি দাবি করলে অনেক সময় সরকার তা করতে বাধ্য হয়। তবে তার উদ্দেশ্য যথাযথ হতে হবে, এরশাদের জরুরি অবস্থার মতো হলে হবে না। মনে রাখতে হবে, জরুরি অবস্থা একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থা, সামরিক আইন নয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও ১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন যখন সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ হঠাৎ ভারতের সামরিক বাহিনিকে চরম উস্কানিমূলকভাবে আমন্ত্রণ জানালেন ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা (সামরিক আইন জারি) নেয়ার জন্য। (সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া বাংলাদেশের সামরিক বাহিনির প্রতি একটি প্রচ্ছন্ন দাবি জানিয়েছেন।) ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন কালবিলম্ব না করে দেশে সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এতে তাঁর সুনামের ক্ষতি হয়েছিল ঠিক কিন্তু দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল।

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে জরুরি অবস্থা জারির মতো কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি ঠিক, তবে দেশের মানুষের জানমাল ও দেশের সম্পদ রক্ষার জন্য সরকারকে অবশ্যই প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারও অযৌক্তিক দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে দাবিকারীকে তুষ্ট করার নীতি গ্রহণ করলে তার পরিণতি ভালো না-ও হতে পারে। অন্তত ইতিহাস এর সাক্ষী। আর হেফাজত তথা জামায়াতের ১৩ দফা দাবি মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে বাঙালির মধ্যযুগীয় কায়দায় আফগানিস্তানের তোরা বোরা পর্বতে প্রবেশ করা।

বাঙালি এ গুহায় প্রবেশ করবে কিনা তা তাদেরই আগামীতে ঠিক করতে হবে।

এপ্রিল ৮, ২০১৩

ড. আদুল মন্নান: শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক।