একটি ফাঁসির আদেশ ও আমার ভাবনা

গতকাল ছিলো দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের রায় । রায়ের প্রতিবাদে জামায়াত হরতাল ডেকেছে। তাই আমার প্রিয়জনরা বলছিলেন যেন অ্যাম্বুলেন্সে যাই। অ্যাম্বুলেন্সে নয়, উপাচার্যের নির্দিষ্ট গাড়িতেই ৩১ কিমি পথ অতিক্রম করে যথাসময়ে কোর্টে পৌঁছে গেলাম।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2013, 02:22 AM
Updated : 1 March 2013, 02:22 AM

৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার মামলার রায় যখন হল, সেদিনও আমি কোর্টে উপস্থিত ছিলাম। কাল মনে হল, কোর্টে ভিড় অনেক বেশি। সবার দৃষ্টি ছিল ১ নং কোর্টের দিকে। কারণ ইতোমধ্যে আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক জাতীয় পুর্নজাগরণে অংশ নিয়েছে শুধু নয়, বাংলাদেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে তাতে শামিলও করে ফেলেছে। সবার দৃষ্টি তাই কোর্টের দিকে। কী রায় সেখানে উচ্চারিত হবে?

 ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাঁর সূচনা বক্তব্য দিলেন। বললেন, ‘‘দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ‘আল্লামা’ খেতাব আছে। তার ওয়াজ শোনে হাজার হাজার মানুষ, দু’দুবার সে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু আমরা এই আল্লামা সাঈদীর বা কোনো সংসদ সদস্যের বিচার করছি না। আমরা ফিরে তাকাব একাত্তরের দিকে। পিরোজপুরে তার গ্রামে তেইশ বছরের এক যুবক যার তেমন পরিচিতিও নেই, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামে তাকে কেউ চেনেও না, তার নাম ‘দেলু’– এই দেলু ওরফে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী চোস্ত উর্দু বলতে পারে, সে হয়েছে পাকিস্তানিদের সহযোগী, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসারদের প্রিয়জন। শান্তি কমিটির মেম্বার হয়েছিল সে। আঞ্চলিক রাজাকার বাহিনীর সদস্য পদে নাম লিখিয়েছে। তার অর্থবিত্তও ছিল না তখন। আমরা বিচার করছি সেই দেলুর সে সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য।’’ মহামান্য বিচারক আরও বললেন, ‘‘সেই বিশটি অভিযোগ আমরা বিবেচনা করেছি, প্রসিকিউশন এবং ডিফেন্স এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি হাজির করেছেন। আমরা উভয়ের যুক্তি শুনেছি। আমরা সবাই একমত হয়ে এ রায় প্রণয়ন করেছি।’’

দু’ঘন্টার বেশি সময় ধরে বিচারকরা রায় পাঠ করলেন। মোট বিশটি অভিযোগের মধ্যে বারোটিতে সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হল না। আমার কাছে মনে হল, এর মূখ্য কারণ ওই একাত্তরে যে গ্রামবাসী সাঈদীর হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন তারা সংখ্যালঘু হিন্দু। তবে মুসলিম সম্প্রদায়ও বাদ পড়েননি। হত্যা, দিনের পর দিন ধর্ষণ, অগ্নিকাণ্ড, লুটপাট এবং বলপ্রয়োগে ধর্মান্তরিত করা- এসব গুরুতর অভিযোগ ছিল যার প্রতিটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু ওই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাক্ষীরা শেষ পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেননি। তারা ছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত। আর বাকি আটটিতে যার দুটিতে হত্যাকাণ্ড আছে, সেগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। তাই ওই দুটি অপরাধের জন্য চুড়ান্ত রায় দেওয়া হল, মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হবে।

এর মধ্যেই ঘাতক সাঈদী চিৎকার করে বলে উঠল, ‘‘ন্যায়বিচার হয়নি; জনগণের চাপে প্রভাবিত হয়ে এ রায় দেওয়া হয়েছে।’’ এবং তিনি এর বিরুদ্ধে আপীল করবেন বলে জানালেন। কোর্টে উপস্থিত লোকজন তার এ ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। তখন পুলিশ অতিদ্রুত তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।

কোর্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। ৫ তারিখে আমি ছিলাম গভীরভাবে বিষণ্ন। তার ছাপ নিশ্চয়ই আমার চেহারায়ও ছিল। আর আজকে আনন্দে উদ্বলিত আমি। মিডিয়ার সবাই আমার এ মুহুর্তের অনুভুতি জানতে চাইল। আমি বলেছি, ‘‘একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় আমরা অর্জন করেছিলাম, ন’মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছিলাম, তেমনি আনন্দ আজ অনুভব করছি।’’

ন্যায়বিচার হয়েছে, এবং বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে যে, এদেশের মানুষ বর্বর নয়। বিয়াল্লিশ বছর পর হলেও বিচার হয়েছে। আমাদের দায়মুক্তি ঘটেছে, আমরা কলঙ্কমুক্ত হয়েছি। এ রায় আরও তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, ৫ ফেব্রুয়রি থেকে শাহবাগে আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে জাতীয় পুনর্জাগরণের সূচনা করেছে, এবং এর ফলে জনতার আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তির যে দাবি উচ্চারিত হয়েছে- সে দাবির সঙ্গে আজকের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় মিলে গেছে।

তাই নতুন প্রজন্মকে অভিবাদন জানাই। আমরা আরও মনে হল, যে বারোটি অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়নি বলে অভিযোগ থেকে পার পেয়ে গেছে এ যুদ্ধাপরাধী- সেগুলোর ব্যাপারেও বাদীপক্ষের আপীল করা উচিত। আমার কাছে এ-ও মনে হয় যে, এ রায় ঘোষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ওইসব সাক্ষী যারা জীবনের ভয়ে ভীত ছিল, সত্য উচ্চারণে নিশ্চুপ ছিল, তারা শঙ্কামুক্ত হয়েছে। সাহসে বলীয়ান হয়ে তারা এগিয়ে আসবে সত্য অনুসন্ধানে সাহায্য করতে। আর শুধু এই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নয়- বাংলাদেশের সর্বত্র যেখানেই যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যেখানে নিপীড়িতের আর্তনাদ এখনও শোনা যায়- সেখানেই উৎপীড়িত মানুষ যারা বিয়াল্লিশ বছর ধরে প্রহর গুনেছে ন্যায়বিচারের আশায়, তারা সাহসী হয়ে সকল ভীতি উপেক্ষা করে এগিয়ে আসবে- যুদ্ধাপরাধীদের শনাক্ত করতে, তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে।

অন্যদিকে এ রায়ের ফলে নতুন প্রজন্ম তো বটেই, পুরো দেশজুড়ে কোটি কোটি জনগণের মধ্যে যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে তার সামনে ওই জামায়াত এবং তাদের মিত্র বিএনপির সব ষড়যন্ত্র ও গৃহযুদ্ধের হুমকি খড়কুটোর মতোই উড়ে যাবে। এমন কী প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে এখনও যাদের আস্থা আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি- এখনও যারা ওই জীবনানন্দ দাসের ‘অদ্ভুত আঁধার’ কবিতায় যেভাবে বলা হয়েছে, ‘‘যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,/ এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়/ মহত সত্য বা রীতি কিংবা শিল্প অথবা ঘটনা’’- তারা নিশ্চয়ই নতুন প্রজন্মের কাতারে শামিল হবেন।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন: উপাচার্য, জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।