মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনা

স্বাধীনতার মাসে ঘুরে আসতে পারেন এসব স্মৃতিময় স্থান থেকে।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2015, 02:51 AM
Updated : 26 March 2015, 02:56 AM

বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিল এদেশে। দীর্ঘ এই নয় মাসে ত্রিশ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছিল পাক হানাদার বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সেইসব শহীদদের স্মৃতি চির জাগরুক রাখতে দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ ও ভাস্কর্য।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

জাতীয় স্মৃতিসৌধ

ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের নবীনগরে নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণউৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৮২ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এর স্থপতি সৈয়দ মঈনুল হোসেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধের উচ্চতা ১৫০ ফুট।

সাতজোড়া ত্রিভুজাকার দেয়ালের মাধ্যমে ছোট থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সৌধটি। কংক্রিটের এই সাত জোড়া দেয়ালের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি সময়কালকে নির্দেশ করা হয়েছে। মোট ১০৮ একর উঁচুনিচু টিলা আকৃতির জায়গার উপর বিস্তৃত সবুজ ঘাসের গালিচায় আবৃত দেশি বিদেশি গাছের বাগান আর লাল ইটের রাস্তা সমৃদ্ধ এই সৌধ ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করে। স্মৃতিসৌধ চত্ত্বরের পাশেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের দশটি গণকবর। আর এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে কৃত্রিম লেক। জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে কোনো প্রবেশ মূল্য লাগে না। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মেহেরপুর। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অন্যতম একটি স্থান হলো মেহেরপুরের মুজিবনগর। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ আম্রকাননে বাংলাদেশের অন্তরবর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। এর আগে ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশে বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহন করেন। এরপরে বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর। ১৯৭১ এর এ ঘটনাকে  চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল সেখানে উদ্বোধন করা হয় এ স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধটির নকশা করেন স্থপতি তানভীর করিম। এর স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য হলো ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের উপর মূল বেদীকে কেন্দ্র করে ২০ ইঞ্চি পুরু ২৩টি দেয়াল, যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক। সৌধের ২৩টি স্তম্ভ ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের সংগ্রামের প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখতে বসানো হয়েছে ৩০ লাখ পাথর।    

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নিদর্শন ও স্মারকচিহ্নসমূহ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১৯৯৬ সনের ২২ মার্চ ঢাকা শহরের সেগুনবাগিচার একটি পুরানো  দ্বিতল বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য, প্রমাণাদি, নিদর্শন, রৈকর্ডপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে এখানে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ছয়টি গ্যালারি রয়েছে। প্রথম গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে বাঙালির ঐতিহ্যের পরিচয় এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিহ্ন। দ্বিতীয় গ্যালারিতে ১৯৪৭ এর দেশভাগ-পরবর্তী পাকিস্তানি শাসন-শোষণের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তৃতীয় গ্যালিরিতে প্রদর্শিত হয়েছে একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, ২৫শে মার্চ সংঘটিত গণহত্যা, স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রতিরোধ ও শরণার্থীদের জীবনচিত্র। দোতলার তিনটি গ্যালারিতে রয়েছে প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক, পাকিস্তান সেনা ও তাদের দোসরদের বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং বাঙালির বিজয় দৃশ্য।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিশ্বের অপরাপর আটটি দেশের সমভাবাপন্ন জাদুঘরের সঙ্গে মিলে গঠন করেছে ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব হিস্টিরিক সাইট মিউজিয়ামস অব কনসান্স। এ জাদুঘরের সংগৃহীত স্মারক সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। রোববার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর। প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি পাঁচ টাকা।

অপরাজেয় বাংলা। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

অপরাজেয় বাংলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্ত্বরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্কর্য অপরাজেয় বাংলা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার নারী পুরুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বিজয়ের প্রতীক এই ভাস্কর্য। এর স্থপতি সৈয়দ অব্দুল্লাহ খালিদ।

রায়েরবাজার বধ্যভূমি। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

রায়ের বাজার বধ্যভূমি

ঢাকা শহরের পশ্চিমে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশেই শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দেশের প্রখ্যাত সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে এই স্থানের পরিত্যক্ত ইটের ভাটার পেছনের জলাশয়ে ফেলে রাখে পাকিস্তানী দোসররা। এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড স্মরণীয় করে রাখার জন্য ইটের ভাটার আদলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় জায়গাটিতে। স্মৃতিসৌধে লাল ইট ও সিমেন্টের গাঁথুনির প্রাধান্যই বেশি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে সৌধের একমাত্র দেয়ালটি নির্ভীক প্রহরীর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এর স্থপতি ফরিদ উদ্দীন আহমেদ। সপ্তাহের সাতদিনই সকাল ৮ থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে।

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুর। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ

ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় এদেশের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবিদের নির্বিচারে হত্যা করে। তাঁদের স্মরণে ’৭১য়ের ২২ ডিসেম্বর মিরপুরে এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

জাগ্রত চৌরঙ্গী। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

জাগ্রত চৌরঙ্গী

ঢাকার অদূরে গাজীপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের এই ভাস্কর্য। ১৯৭১ সালে নির্মিত এই ভাস্কর্যের স্থপতি আব্দুর রাজ্জাক।

শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে শম্ভুগঞ্জের বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতুর কাছেই এই স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়। নির্মাণ করেছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন। 

এই স্মৃতিসৌধের কেন্দ্রে রয়েছে একটি রাইফেল। রাইফেলের বেয়োনেটে ফুটন্ত শাপলা। ৫০ ফুট উঁচু স্তম্ভটি দাঁড়িয়ে আছে মশালের আকৃতিতে। সৌধটির চারদিকের চারটি দেয়ালে রয়েছে চাররকমের মুর‌্যাল। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’য়ের গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১’য়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিমূর্ত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চার দেয়ালের মুর‌্যালে।

এছাড়া ময়মনসিংহের কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আরেক ভাস্কর্য ‘বিজয় ৭১’।

শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ, ময়মনসিংহ। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

স্মৃতি অম্লান

মহান মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিসৌধ রয়েছে বিভাগীয় শহর রাজশাহীর কেন্দ্রস্থলে। শহরের শহীদ ক্যাপ্টেন বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সড়কের দ্বীনেভদ্রা এলাকায় ১৯৯১ সালের ২৬শে মার্চ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। স্থপতি রাজিউদ্দিন আহমদ। সৌধটিতে মোট তিনটি স্তম্ভ আছে। প্রতিটির গায়ে ২৪টি করে ধাপ, ধাপগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আন্দোলনের ক্রমবিবর্তন ও স্বাধীনতার ফসল। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের নির্দেশ করা হয়েছে স্তম্ভের গায়ের ৩০টি ছিদ্রের মাধ্যমে। বেদিমূলে রাখা আছে নীল-শুভ্র পাথরের আচ্ছাদন, যা দুই লাখ নির্যাতিত নারীর বেদনাময় আর্তির কথা ইঙ্গিত করে। সৌধের চূড়ায় রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রের লালগোলক যা স্বাধীনতা যুদ্ধের উদীয়মান লাল সূর্যের প্রতীক।

সাবাশ বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

সাবাশ বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক ভাস্কর্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার চত্বরে মুক্তাঙ্গনের উত্তরপাশে অবস্থিত। রাকসু এবং দেশের ছাত্রজনতার অর্থ সাহায্যে শিল্পী নিতুন কুন্ড এই ভাস্কর্য বিনা পারিশ্রমিকে নির্মাণ করেন। ১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এটি উদ্বোধন করেন। এই স্মৃতিস্তম্ভে আছে দুজন মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি। একজন অসম সাহসের প্রতীক, অন্য মুক্তিযোদ্ধার হাত বিজয়ের উল্লসে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে পতাকার লাল সূর্যের মাঝে।

কামালপুর স্মৃতিসৌধ

জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুর স্বাস্থকেন্দ্র সংলগ্ন এই স্মৃতিসৌধ অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় কামালপুরে ছিল পাক বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। ৩১ জুলাই ১১ নং সেক্টরের ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ন যোদ্ধারা কামালপুর আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মোমতাজ, আহাদুজ্জামান, আবুল কালাম আজাদসহ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এসব শহীদদের স্মরণেই এখানে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।