বস্তিতে বাড়ছে ছোট পরিবার

পরিবারে দুই সন্তানের ধারণা এতদিন বাংলাদেশের শিক্ষিত পরিবারগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বস্তিগুলোতেও ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

নূরুল ইসলাম হাসিববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Oct 2014, 07:05 PM
Updated : 14 Oct 2014, 07:05 PM

শহর এলাকার বস্তির অনেকেই এখন পরিবারের আকার ছোট রাখার পক্ষে বলে সাম্প্রতিক নগর স্বাস্থ্য সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

‘বাংলাদেশ আরবান হেলথ সার্ভে ২০১৩’ এ পরিবারের আকার নির্ধারণ, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যবহার, দক্ষ ধাত্রী এবং পুষ্টি সম্পর্কিত বিষয়ে বস্তি এবং বস্তির বাইরের পরিবারগুলোর মধ্যে পার্থক্য কমে আসার তথ্যও এসেছে।      

যদিও বস্তিতে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার এখনো বেশি থাকার কোনো উল্লেখ করা হয়নি এতে।

প্রায় সাত বছর পর নগর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নতুন এই সমীক্ষা মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়। প্রথম সমীক্ষাটি চালানো হয়েছিল ২০০৬ সালে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা এবং ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট গিবসন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরের বস্তিবাসীরা স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর শরণাপন্ন হয় বেশি। কিন্তু প্রায়ই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সেবা নিতে গিয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হয়।

অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপনকারী ইউএসএআইডির পপুলেশন, হেলথ, নিউট্রিশন অ্যান্ড এডুকেশন অফিসের সিনিয়র অ্যাডভাইজর ড. কান্তা জামিল বলেন, “নগর স্বাস্থ্য নিয়ে এনজিওগুলো কাজ শুরুর পর থেকেই উন্নতির এসব পার্থক্য ধরা পড়ছে।”

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের করা সমীক্ষায় ইউএসএআইডি ছাড়াও অর্থ সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডি। সহযোগিতা করেছে আইসিডিডিআর,বি এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মেজার ইভাল্যুশন।

সমীক্ষায় বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, জেলা শহর ও পৌর এলাকার বস্তি ও বস্তির বাইরের এলাকার ৫৪ হাজার মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে।  

দেখা গেছে, বস্তির বাসিন্দাদের দুই তৃতীয়াংশ নারী-পুরুষই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে সেসব এলাকায় বসতি গেড়েছেন। পুরুষরা সাধারণত কাজের জন্যই বিভিন্ন এলাকা থেকে বস্তিতে আসেন। আর অধিকাংশ নারী আসেন বৈবাহিক কারণে।    

সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ঢাকার বস্তিগুলোর ২০ শতাংশ বাসিন্দাই বরিশালের, যদিও দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ এই বিভাগের। এদের মধ্যে অধিকাংশই জানিয়েছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা শহরে এসেছে।

বস্তিতে থাকা ৭ শতাংশ মানুষই পরিবেশগত কারণকে তাদের শহরে আসার মূল কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন।

২০০৬ সালের তুলনায় এ সময়ের মধ্যে বস্তির পরিবারগুলোর কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশুদ্ধ পানির জন্য এখনো বস্তিবাসীকে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হলেও ২০০৬ সালের তুলনায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তাছাড়া সবাই এখন বিদ্যুৎ সুবিধাও পাচ্ছে। তবে মানুষের তুলনায় শৌচাগার কম থাকায় স্যানিটেশন ব্যবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি।  

২০০৬ সালে যেখানে মাত্র ২০ শতাংশ বস্তিবাসী মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে, বর্তমানে এ হার ৯২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। 
চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে- সরকারি জমিতে বসবাসকারী বস্তি পরিবারের সংখ্যা ২০০৬ সালে ২০ শতাংশ থাকলেও তা এখন কমে ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

পরিবারের আকার

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সরকারের ‘দুই সন্তান’ লক্ষ্য পুরোপুরিই বাস্তবায়িত হয়েছে বস্তিগুলোয়, সিটি করপোরেশন এলাকার সাধারণ পরিবারগুলোর মধ্যেও যা অনেক কম।   

এতে দেখানো হয়েছে, সিটি করপোশেন এলাকার সাধারণ পরিবারে একজন নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার হার ১ দশমিক ৭ হলেও বস্তির সব নারীর ক্ষেত্রে তা ২। আর অন্য শহর এলাকায় এটি ১ দশমিক ৯।

তবে বস্তিতে অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ে এবং মা হওয়ার প্রবণতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

পরিবার পরিকল্পনা

বস্তির বাইরের এলাকার চেয়ে বস্তির দরিদ্র মানুষের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের ব্যবহার অনেক বেশি বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে।  

দুই সমীক্ষার মধ্যবর্তী সময়ে বস্তিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের ব্যবহার বেড়েছে ১২ শতাংশ। বিপরীতে বস্তির বাইরের এলাকায় এই বৃদ্ধির হার মাত্র দুই শতাংশ।  

বস্তির দম্পতিরা ২০১৬ সালের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের হার ৭২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যের প্রায় কাছাকাছি পৌছে গেছে বলে এতে বলা হয়েছে।     

বস্তিবাসীর কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ পৌছে দেয়ায় এগিয়ে বেসরকারি খাত।

মাতৃস্বাস্থ্য

বস্তিবাসী প্রায় অর্ধেক নারী গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় পযন্ত চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকেন। যথারীতি বস্তির বাইরের নারীদের মধ্যে সন্তান জন্মকালীন স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার হার বেশি।

সমীক্ষার আওতায় প্রায় সব এলাকাতেই দেখা গেছে, খুব কম ক্ষেত্রেই ঘরে সন্তান জন্মের সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী পাওয়া যায়।

সব শহুরে এলাকার মাত্র ২-৪ শতাং নবজাতক জন্মপরবর্তী প্রয়োজনীয় সেবা পায় বলে এতে বলা হয়েছে। 
সমীক্ষাভুক্ত তিন শহুরে এলাকায়ই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে (সিজারিয়ান বা সি-সেকশন)সন্তান জন্মদানের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই এ পদ্ধতিতে বেশি সন্তানের জন্ম দেয়া হচ্ছে।

শিশু স্বাস্থ্য ও পুষ্টি

অনুষ্ঠানে আইসিডিডিআর,বির শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক শামস আল আরেফিন জানান, বস্তির প্রতি ১৮ শিশুর মধ্যে একটি শিশু পাঁচ বছরে পা দেয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে।

বস্তিতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ৩০ এবং এক বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ২২ শতাংশে  নেমে আসলেও এখনো এই হার বস্তির বাইরের এলাকাগুলোর চেয়ে বেশি।

তিনি জানান, বস্তির বাইরের এলাকার চেয়ে বস্তিতে অনুর্ধ্ব-৫ বয়সী শিশুর মৃত্যুহার দ্বিগুণ। আর এক থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার বস্তিতে ১৪ গুণ বেশি।  

“এর মানে হচ্ছে সিটি করপোরশেন এলাকায় বস্তির সংখা দ্বিগুণ হারে বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশু মৃত্যুর হারও।”

শিশুর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা সরকারের একটি চ্যালেঞ্জ হলেও বস্তিতে এখনো বিষয়টির কোনো উন্নতি হয়নি। এর ফলে এখনো বস্তিতে অনুর্ধ্ব-৫ বছরের অর্ধেক শিশুই বয়সের তুলনায় খর্বাকৃতির হয়।

তবে দুই সমীক্ষার মধ্যে গত সাত বছরে বস্তি এবং বস্তির বাইরের মানুষের মধ্যেকার পুষ্টি গ্রহণের পার্থক্য কিছুটা কমে এসেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সমীক্ষার অন্যতম গবেষক আইসিডিডিআর,বির জনসংখ্যা বিভাগের পরিচালক পিটার কিম স্ট্রিটফিল্ড জানান, বস্তিতে শিশু মৃত্যুর হার কেন বেশি এর কারণ ব্যাখ্যা করাটা কঠিন।   

“পরিবেশ এর (শিশু মৃত্যু) একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু সঠিক কারণ আমি জানি না। এজন্য আমাদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।”

সঙ্গত কিছু কারণেই বস্তির পরিবারগুলো ‘দুই সন্তান’ প্রচারণা লুফে নিয়েছে বলে মনে করেন ড. কান্তা জামিল।

“বসবাসের জায়গা এর একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু বস্তিবাসীরা যে এই নীতি গ্রহণ করেছে এটা খুবই বিস্ময়কর।”

নগরবাসীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ‘ভালো একটি উপায়’ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

তবে এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের জন্য কিছু নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।