মাতৃদুগ্ধ: পরামর্শ মানতে অনীহা উচ্চবিত্তের

বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে ছয় মাস পর্যন্ত বয়সী শিশুদের শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো বা ‘এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং’র (ইবিএফ) হার বেশি। শিশুদের দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানোর হারের ক্ষেত্রেও বেশ এগিয়ে বাংলাদেশ।

কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2014, 06:45 AM
Updated : 4 Sept 2014, 03:28 AM

এক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরিই সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও নার্সরাও চেষ্টা করে যাচ্ছেন শিশুর জন্য মায়ের দুধের গুরুত্ব সম্পর্কে মাসহ অন্য অভিভাবকদের সচেতন করতে।

তবে এসব পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ একেবারে নির্বিঘ্নে দিতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। একটু বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ মেনে না চলতে বেশ অনীহা রয়েছে বলে জানান মাঠ পর্যায়ের বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকর্মী।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের (ইবিএফ) হার ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশ। 

মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে বেসরকারি সংস্থা টিচিং অ্যাসিসটেন্স ফর হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন (তান) ফাউন্ডেশন, ব্র্যাক, সীমান্তিকসহ আরো বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা।নিজ নিজ প্রকল্প এলাকায় প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে কাজটি করেন সংস্থাগুলোর মাঠকর্মীরা।

তান ফাউন্ডেশনে ফিল্ড ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত রত্না গোমেজ জানান, একজন মা গর্ভবতী হওয়ার পর থেকেই মায়ের মাসওয়ারি পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেন তাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা।এছাড়া শিশুর জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠার প্রথম দুই বছর পর্যন্ত ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণসহ শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতেও বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন তারা।  

জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ খাদ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় পুষ্টিগুণ প্রাকৃতিকভাবেই সে পেয়ে থাকে মায়ের দুধ থেকে। শিশুর শরীরে প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় মায়ের দুধের মাধ্যমেই।

তাই শিশুদের জন্য মাতৃদুগ্ধ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারও বিশেষ নীতি গ্রহণ করেছে। এর বাস্তবায়নে নবজাতকদের ইবিএফ’র আওতায় আনা এবং নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে যথাসম্ভব পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ও নার্সরা।

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সিনিয়র স্টাফ নার্স রাশেদা ইসলাম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রতি মাসে ৩০-৩৫ জন নারীর সন্তান প্রসব করানো হয়ে থাকে। সাধারণত পাঁচ-ছয় মাসের প্রসূতি অবস্থা থেকেই মায়েদের আমরা বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকি। সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর সময় কিভাবে ধরে রাখতে হবে, বুকে দুধ ঠিকমতো না আসলে কিভাবে পরিচর্যা করতে হবে প্রভৃতি সব বিষয়েই পরামর্শ দেই আমরা।”

মায়ের দুধ না পেলে সহজ বিকল্প হিসেবে কৌটার দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা কখনোই কৌটার দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেই না। বরং কারো বুকের দুধ দিতে সমস্যা হলে তার সমস্যার মূল কারণটা বুঝে সেভাবে পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করি। যারা লেখাপড়া একটু কম জানে, তারা বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে পরামর্শ নিয়ে শিশুকে কৌটার দুধ দিয়ে থাকে।”

তিনি বলেন, ফেঞ্চুগঞ্জের বেশিরভাগ মানুষই নিম্নবিত্ত। উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তারাই বেশি আসে। কৌটার দুধ বা বিকল্প শিশুখাদ্য কেনার সামর্থ্য তাদের খুব বেশি হয় না।

একই কথা বলেন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান।

ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রায় দুই দশক ধরে কর্মরত নার্স রাশেদা বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যারা চিকিৎসা বা পরামর্শ সেবা নিতে আসেন, তাদের প্রায় ৪০ শতাংশই ইবিএফ চালিয়ে যান। ছয় মাস পরে সম্পূরক খাদ্য হিসেবেও বাড়ির সাধারণ খাবার খাওয়ানোর সংখ্যাই বেশি। নিম্ন আয়ই এর মূল কারণ বলে মনে করেন রাশেদা।

তবে শুধু নিম্ন আয়ই নয়, সন্তানকে মায়ের দুধ দেয়ার ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময়ে সবার মধ্যেই সচেতনতা বেড়েছে বলে জানান তিনি।

“গত ৬-৭ বছর ধরে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। মায়েদের মুখে ব্র্যাক, সীমান্তিক এসব এনজিওর নাম শুনি যে তারা বিভিন্ন পরামর্শ, প্রশিক্ষণ দেয়,” বলেন রাশেদা।

বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর তুলনায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় সেই সমস্যা ও ফাঁকফোকরগুলো অনেকটাই মেটাচ্ছেন এনজিওগুলোর স্বাস্থ্যকর্মীরা।

তান ফাউন্ডেশনের প্রকল্প এলাকা ঢাকার উত্তর বাড্ডা এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা।

রত্না গোমেজ বলেন, “বাড্ডায় আমাদের প্রকল্প এলাকায় বেশিরভাগ মাই ঢাকার বাইরে থেকে আসা পোশাক শ্রমিক পরিবারের। ফলে তাদের বেশিরভাগই গর্ভবতী অবস্থায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বাইরেই থেকে যান।চট্টগ্রামের আনোয়ারা বেশ প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবার আওতায় তেমনভাবে আসতে পারে না সবাই।”

তান ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ডা. রুখসানা হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিজেদের প্রকল্পের মূল্যায়নের জন্য প্রকল্প এলাকার ভেতরে ও বাইরে গিয়ে জরিপ চালাই আমরা। এ ধরনের জরিপ চালাতে গিয়ে প্রকল্পের বাইরের এলাকাগুলোতে মায়েদের জিজ্ঞাসা করে আমরা জানতে পেরেছি, সরকারি বা বেসরকারি কোনো লোকই তাদের কাছে কোনো পরামর্শ বা সেবা নিয়ে যায়নি। তার মানে এখনো বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী এই প্রচারণা ও সেবার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।”

সাধারণত সব এনজিওতেই স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় স্থানীয় নারীদের, যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসএসসির বেশি হয় না। এতে অনেক মা-ই তাদের পরামর্শ মেনে চলতে চান না বলে অভিযোগ রয়েছে।

তান ফাউন্ডেশনের রত্না গোমেজ বলেন, “কোনো মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা যদি একটু বেশি হয়, তখন তারা স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ শুনতেই চান না। কেউ কেউ শুনলেও মানেন না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।”

একই অভিযোগ করেন সিলেটের বালাগঞ্জে কর্মরত ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মী বিউটি রাণী।

“একটু উচ্চ আয়ের পরিবারগুলোতেও মায়েরা পরামর্শ মানেন না।”

এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার চাইতে বিকল্প শিশুখাদ্য কেনার সার্মথ্য থাকাটাই বেশি প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন তিনি।

শিশুদের জন্য মায়ের দুধের গুরুত্ব প্রচার এবং জন্ম থেকে অন্তত দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করে একে একটি সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে সারা বিশ্বে কাজ করছে ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশন (ওয়াবা)।এর সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও।

ওয়াবার স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য এবং ২৫ বছর ধরে মাতৃদুগ্ধ পান বিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে আসা ডা. রুখসানা হায়দার বলেন, “একটু বেশি পড়াশোনা জানা মায়েরা স্বাস্থ্যকর্মীদের একটু ছোট করে দেখতে চান। মনে করেন যে বেশি পড়াশোনা করেছেন বলে তিনি সবকিছুই বেশি জানেন। তারা এটা বুঝতে চান না যে স্বাস্থ্যকর্মীরা এই বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাই স্বাস্থ্যকর্মীরাই সত্যিকারভাবে তাদের থেকে বেশি জানেন।”