স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান ‘বৃক্ষ মানব’

মাত্র দশ বছর বয়সে ত্বকে ভাইরাসের সংক্রমণে হাত-পায়ে গাছের শাখা-প্রশাখার মতো আঁচিল নিয়ে হাসপাতালে দিন কাটছে খুলনার আবুল বাজানদারের (২৫)।

কামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2016, 02:37 PM
Updated : 31 Jan 2016, 02:59 PM

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে স্থান পেয়েছেন এই যুবক, যার আর্তি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার।  

সরেজমিনে দেখা যায়, আবুলের দুই হাতে প্রায় দশ কেজি ওজনের আঁচিল; পায়েও প্রায় কাছাকাছি। দেখে মনে হয় হাত-পা থেকে গাছের শাখা-প্রশাখা গজিয়েছে।

তাই এরই মধ্যে তার নাম হয়ে গেছে ‘ট্রি ম্যান’ বা ‘বৃক্ষ মানব’।

কিশোর বয়সে বাবার সঙ্গে যে ছেলে ভ্যান চালিয়ে সংসারের আর্থিক যোগানে সহযোগিতা করতো, তিনিই এখন ‍পরিবারের বোঁঝা; খেতে হয় অন্যের হাতে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকেও বললেন সেই কষ্টের কথা। 

“মা-স্ত্রীর হাতেই খাবার খেতে হয়। এক-একটি হাতের আঙ্গুল মনে হয় কয়েক কেজি। উঁচু করতে পারি না; অনেক কষ্ট হয়। তবে দুই পায়ের অবস্থা হাতের মতো নয়। ঘুমের বড়ি ছাড়া ঘুমাতে পারি না।”

স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার আর্তি জানিয়ে আবুল বলেন, “যেভাবে হউক আমি আমার স্বাভাবিক জীবনের ফিরতে চাই। ভ্যান গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে চাই।”

বিরল এই রোগ নিয়ে যখন দেশের গণমাধ্যমে হৈ চৈ, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও আবুলকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছে বেশ আগ্রহের সঙ্গে।

ডেইলি মিরর লিখেছে- ‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস’ বা এইচপিভি’র কারণে ত্বক আক্রান্ত হয়। তবে বিরল এই রোগ এবং তার প্রতিকার নিয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

তবে নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড তাদের প্রতিবেদনে এই রোগকে ‘এপিডারমোডাইসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

আবুলের অবস্থা জানতে চাইলে বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, আবুলের মতো রোগী বিশ্বে এর আগে মাত্র দুজন পাওয়া গেছে; যার একজন রোমানিয়ার এবং অপরজন ইন্দোনেশিয়ার।

“২০০৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার রোগীর অপারেশন হওয়ার পর ভাল হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।”

এই ‘বৃক্ষ মানবের’ চিকিৎসার জন্য অধ্যাপক মো. আবুল কালামকে প্রধান করে ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।

অন্য সদস্যরা হলেন, অধ্যাপক মো. সাজ্জাদ খন্দকার, অধ্যাপক রায়হানা আওয়াল, অধ্যাপক খান মো. আবুল কালাম আজাদ, সহযোগী অধ্যাপক এমদাদুল হক ও সামন্ত লাল সেন।

আবুল কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্যাথলজিক্যাল কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই পরীক্ষাগুলোর প্রতিবেদন পেতে পাঁচ থেকে সাতদিন সময় লাগবে।

“প্রতিবেদন পাওয়ার পর যদি আমাদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে মিলে যায় তাহলে অস্ত্রোপচারে যাব। তবে অস্ত্রোপচার করা হবে কয়েকটি ভাগে।”

রোগের উৎস সম্পর্কে জানা না থাকলেও ‘জেনেটিক ও ভাইরাস’ জনিত কারণ এর পেছনে রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবুল কালাম।

তথ্য ঘেটে জানা গেছে, এইচপিভি একগুচ্ছ ভাইরাসের নাম, যা শরীরের ত্বক ও আর্দ্র ঝিল্লিতে সংক্রমিত হয়। এ পর্যন্ত একশ’র বেশি ধরনের এইচপিভি ভাইরাসের হদিস পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০ ধরনের এইচপিভি জননেন্দ্রীয়কে আক্রান্ত করতে পারে।

সব ধরনের এইচপিভিই শরীরে আঁচিলের কারণ। এ সংক্রমণ খুব দ্রুত গতিতে ত্বকের বাইরের স্তরে ছড়িয়ে পড়ে।

আবুলের মা আমেনা বিবিও তার ছেলের রোগের বিবরণে যা বলেছেন, তার সঙ্গে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি অনেকটাই মিলে যায়।

“ছোট্ট একটি আঁচিল থেকে আজ আমার ছেলের এই অবস্থা। প্রথম দিকে গ্রামের কবিরাজি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করালেও এক পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য ভারত নিয়ে গিয়েছিলাম।”

চার ভাই চার বোনের মধ্যে আবুল ছয় নম্বর। বাবা মানিক বাজানদার ভ্যানচালক।

আমেনা বলেন, “আঁচিলের প্রকোপ যখন দিন দিন বাড়তে থাকে তখন ছেলেকে একটি বিয়ে করাই; তাও পাঁচ বছর আগে। আবুলের একটি তিন বছর বয়সের মেয়ে রয়েছে।”

এদিকে যন্ত্রণা নিয়ে নানা ঘাট পেরিয়ে হাসপাতালে স্থান হলেও সেখানে রীতিমতো ‘দর্শনীয় বস্তুতে’ পরিণত হয়েছেন আবুল।

তার বোন আদুরি বলেন, “দুই মিনিটও বসে থাকতে পারি না, কেউ না কেউ দরজায় কড়া নাড়ে। দুপুরেও ঠিক মতো খাওয়াতে পারিনি; শুধু মানুষ আসে।”