স্থাপত্যের ক্ষরণ, স্মৃতির মৃত্যু

শতবর্ষী দুই তলা ভবনটিতে সাজসজ্জা, জ্বলতে থাকা বাতি আর মানুষের আনাগোনা নজর কাড়ছে পথচারীদের; প্রতিদিনের পথচলতি মানুষের উপক্ষো পেরিয়ে আজ যেন আগ্রহ কাড়তে পেরেছে বাড়িটি।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 August 2017, 05:04 PM
Updated : 4 August 2017, 08:14 PM

ভেতরে ঢুকতেই বসার ঘরের দেয়ালজুড়ে রক্ত প্রবাহের ছাপ; মেঝেতে কালো কালো শিরা-উপশিরা; শিরোনাম- ব্লিডিং অফ আ আর্কিটেকচার।

নগরীর আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌধুরী সড়কের দ্বিতল বাড়িটি একসময় ছিল প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। কোলাহলমুখর সেই বাড়ি বছরখানেক আগে ছেড়ে গেছেন এর বাসিন্দারা।

নতুন রূপ লাভের অপেক্ষায় নিরবে দাঁড়িয়ে বিগত কালের সাক্ষী এই বাড়ি। সপ্তাহ খানেক পরই শুরু হবে বাড়িটি ভাঙার কাজ।

সেই বাড়িতে দুই দিনের এই স্থান নির্ভর শিল্প প্রদর্শনীতে (সাইট স্পেসিফিক আর্ট প্রজেক্ট) অংশ নিয়েছেন ১২ জন শিল্পী। অধিকাংশ শিল্পকর্মের উপকরণ এই বাড়ি থেকেই সংগ্রহ করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকল বিভাগের শিক্ষক সঞ্জয় চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্থাপত্যের রক্তক্ষরণ প্রতিফলিত করার চেষ্টা থেকেই এমন দৃশ্যায়ন। স্থাপত্য এমন এক ধরনের শিল্প মাধ্যম যাতে মানুষের বসবাস।

“যে বাড়িতে একজন মানুষ বসবাস করে সেই বাড়িকে ঘিরে তার স্মৃতি বেড়ে ওঠে। এই বাড়িটি কিছুদিন পর থাকবে না। তাই এই স্থাপত্যের ভেতর একধরনের ক্ষরণ হচ্ছে। এই ক্ষরণের সঙ্গে এই বাড়ির সাথে জড়িত মানুষদের স্মৃতির মৃত্যুও আসন্ন দেখতে পাচ্ছি।”

 ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’ (নৈঃশব্দ্যের শব্দ) শিরোনামে স্থাননির্ভর এই শিল্প কর্মের আয়োজক সন্তরণ আর্ট অর্গানাইজেশন। এই বাড়ির মালিক ওমর ফারুক ইউসুফ ও শোয়েব ইউসুফ এই সংগঠনের উপদেষ্টা।

প্রদশর্নীর সমন্বয়ক অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, ১৯১০ সালে এই বাড়িটি নির্মাণ করেন ডা. ওমর ইউসুফ। তার পুত্র এ এফ এম ইউসুফ ও নাতি ওমর ফারুক ইউসুফ।

শুক্রবার বিকেলে প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে ওই পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে আসেন বাড়িটিতে।

ওমর ফারুক ইউসুফ বলেন, আজ আবার ঘুরে ঘুরে দেখলাম সারাজীবনের স্মৃতি জড়ানো এই বাড়ি। বিদায়ের আগে যেন সেজেছে নতুন সাজে।

নিচতলার ডান পাশের প্রথম কক্ষটি সাজানো হয়েছে আধো অন্ধকারে পুরনো ক্যালেন্ডারের পাশে বাড়ির বিভিন্ন অংশের ছবি দিয়ে।

আলোকচিত্রী আহমেদ রাসেল বলেন, সিঁড়ির ছবিগুলো বেশি ব্যবহার করেছি। সিঁড়ি সময়ের প্রতীক। আর পুরনো বছরের ক্যালেন্ডারগুলো এই বাড়ি থেকেই খুঁজে নেয়া।

ক্যালেন্ডারের মতই বাড়ির পুরনো নানা উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে শিল্পকর্মগুলোতে।

দোতলায় কোনার ঘরটাতে নীলচে আলোয় পুরনো এক সুটকেস থেকে বেরিয়ে উড়ে চলেছে ‘স্বপ্নের ডানা’।

শিল্পী শতাব্দী শাওন বলেন, পুরনো আশা থেকে নতুন আশায় যাত্রা করে প্রতিটি মানুষ। এসব পাখির ডানা আশার প্রতীক।

স্নানঘরও বাদ যায়নি শিল্পকর্মের ছোঁয়া থেকে। শিল্পী মেহরুন আক্তার বাড়ির দোতলার স্নানঘরটি সাজিয়েছেন দুঃখের রঙে।

তিনি বলেন, নীল রঙের জল ধারা যেন বয়ে চলা কষ্ট। প্রতিটি মানুষের এমন কিছু কষ্ট থাকে যা সে অন্যের সাথে ভাগ করে না। একাকী যাপন করে। হয়ত এখানেই কেউ গোপনে কেঁদেছে। তাই নীল সুতোয় চোখের ফর্ম দেয়া হয়েছে মেঝেতে।

নিচতলার বাঁদিকের কক্ষে শিল্পী রোকসানা বাহারের ‘শ্যাডো ইন্সটলেশন’। আলো-ছায়ার খেলায় কতগুলো মানুষের অবয়ব ফুটে আছে দেয়ালে দেয়ালে। ঝি ঝি পোকার ডাক আসছে যেন কাছে কোথাও থেকে।

রোকসানা বাহার বলেন, এই বাড়ি তো থাকবে না। শুধু কারো কারো মনে থেকে যাবে বাড়িটার ছায়া।

“এখনো পুরনো এই বাড়ির নিরেট অন্ধকারে হয়ত কান পাতালে শোনা যায় অতীতের শব্দরাশি। তাই ঝি ঝির ডাকের সাথে মিলিয়ে এমন শব্দ।”

ব্রিটিশ আমলে তৈরি বাড়িটির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ফেলা আসা সময়ের ছবি।

তাই বাড়িটির জানালা, রেলিং, সিঁড়ি, ভ্যন্টিলেটরসহ নানা স্থাপত্য ফর্মের ছবি দিয়ে নিজের শিল্পকর্মটি সাজিয়েছেন শিল্পী শাওন চৌধুরী।

প্রদশর্নীর সমন্বয়ক অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, আমরা আসলে বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতে ফিরে দেখার চেষ্টা করছি মাত্র। চট্টগ্রাম শহর যে অনেক পুরনো। এর স্থাপত্যকলাই সে প্রমাণ দেয়।

“শুধু অতীতের এই নির্দশনটা মানুষকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি। ইতিহাসের তথ্য-নমুনাগুলো মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে যাবে। হাজার বছরের পুরনো এই শহর সম্পর্কে মানুষ জানবে।”

স্থানীয় এক বৃদ্ধ তার নাতিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বাড়িটি দেখতে। দাতু-নাতি হাত ধরাধরি করে ঘুরে দেখছেন প্রতিটি কক্ষ। বাইরে তখন সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে।

প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক অলক রায়।