সরল মুস্তাফিজ মাঠে দুর্বোধ্য!

মাঠের ভেতরে-বাইরে অদ্ভুত বৈপরীত্য মুস্তাফিজুর রহমানের। ওয়ানডে অভিষেকেই ৫ উইকেট নেওয়া বাঁহাতি পেসারের স্লোয়ার কাটারগুলো যেমন দুর্বোধ্য, মাঠের বাইরে আবার তিনি আশ্চর্য রকমের সরল। ক্রিকেট দর্শনও খুব সাধারণ।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2015, 10:56 AM
Updated : 20 June 2015, 09:48 AM

১৯ বছর ২৮৫ দিন - বৃহস্পতিবার অভিষেক ওয়ানডের দিন মুস্তাফিজের বয়স। এই উপমহাদেশের ক্রিকেটারের বয়স বিভ্রান্তিকর; আনুষ্ঠানিক বয়সের চেয়ে সত্যিকারের বয়স প্রায় সবারই বেশি। মুস্তাফিজের বয়সটাও বিভ্রান্তিকর, তবে উল্টোদিক থেকে!

কাছ থেকে দেখলে মুস্তাফিজের ২০ ছুঁইছুঁই বয়সটাকে মনে হয় বড্ড বেশি। চেহারা এখনও কৈশোরসুলভ; লিকলিকে শরীরটা যেন তার সাক্ষ্য। আর হাসলে তো একদমই যেন শিশু! একেকটা উইকেট পান, সতীর্থরা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেন। মুস্তাফিজ হাসেন, লাজুক হাসি।

ম্যাচ শেষ হওয়ার পর তিনি উদ্‌যাপনের মধ্যমণি। সতীর্থদের আলিঙ্গন, পিঠ চাপড়ে দেওয়া, হাই ফাইভ। অধিনায়ক মাশরাফি ছুটে এসে মাথার চুল এলোমেলো করে দেন, চুমু এঁকে দেন কপালে-মুখে। মুস্তাফিজের মুখে শুধু লাজুক হাসি! ছোটো ভাইয়ের মমতায় মাশরাফি তাকে বুকে জড়িয়ে রাখেন। অধিনায়কের বুকে আশ্রয় নিয়ে যেন পাদপ্রদীপের আলো থেকে নিজেকে আড়াল করতে চান মুস্তাফিজ।

ম্যাচ শেষের অনেকক্ষণ পর, শের-ই-বাংলার ড্রেসিং রুম থেকে সংবাদ সম্মেলনের পথে মাশরাফি ও মুস্তাফিজ। দুজনকে ঘিরে সংবাদকর্মীদের মিছিল। সবার সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে অধিনায়ক বলেন, “আমাকে নয়, ওকে বেশি করে অভিনন্দন জানান।” সবাই ছুটে যায় মুস্তাফিজের দিকে। তার মুখে কথা নেই, শুধুই লাজুক হাসি!

একটু পর, টইটম্বুর সংবাদ সম্মেলন কক্ষ। ওয়ানডে অভিষেকের মত এত বড় সংবাদ সম্মেলনেও অভিষেক মুস্তাফিজের। সেই লাজুক হাসি উধাও। চেহারায় ঘাবড়ানোর ছাপ স্পষ্ট। একবার ঢোক গিললেন, মাইক্রোফোনের সামনে অনভ্যস্ততাও ফুটে উঠল। একটু যেন বিব্রতও। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ধেয়ে আসছে। একেকটা প্রশ্নে প্রায় চমকে উঠছেন। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, মাঝে-মধ্যে দুই পাশে বসা মিডিয়া ম্যানেজার আর অধিনায়কের দিকে অসহায় চাহনি!

কৌতূহলের শেষ নেই সবার। কীভাবে খেলার শুরু, কার হাত ধরে শুরু, কার অবদান বেশি, বাড়ি কোথায়, স্কুল কোনটি, আদর্শ কে... কত প্রশ্ন!

মুস্তাফিজের উত্তরে প্রশ্নকর্তার কৌতূহলের কিছুই মেটে না। তিন-চার শব্দের উত্তর, খুব লম্বা উত্তরটাও টেনেটুনে দুই লাইনের। সেটাও এমনই মিনমিনে কণ্ঠে যে কান খাড়া করেও শোনা দায়। যেন অন্তহীন এক কঠিন পরীক্ষায় নেমেছেন, শেষ হলেই বাঁচেন! সংবাদ সম্মেলনে বড্ড অসহায় দেখাল মুস্তাফিজকে। কে বলবে, একটু আগে আসল পরীক্ষাটাই জয় করে এসেছেন তুড়ি বাজিয়ে!

সেটি ক্রিকেট মাঠের পরীক্ষা, ২২ গজের পরীক্ষা। মাঠের বাইরে আশ্চর্য সহজ-সরল ছেলেটি, জীবনের যাবতীয় জটিলতা এখনও স্পর্শ করতে পারেনি যাকে, মাঠে বল হাতে সেই ছেলেটিই ভীষণ দুর্বোধ্য, প্রচণ্ড জটিল! কোনো ডেলিভারি বাঁহাতির সহজাত অ্যাঙ্গেলে বেরিয়ে যাচ্ছে, কোনোটি আবার সুইং করে। কোনো কোনোটি আবার সোজা ঢুকছে। আর এসবের সঙ্গে সেই ‘বিষাক্ত’ স্লোয়ার, কাটার!

স্লোয়ার ডেলিভারি ক্রিকেটে পুরোনো হয়ে গেছে অনেকদিন। ব্যাটসম্যানদের জন্য এটি এমন কোনো চমকও নয়। কিন্তু মুস্তাফিজ তার নিয়মিত ডেলিভারির সঙ্গে এই ‘স্টক ডেলিভারি’ এমন ভাবে মিশিয়ে দেন, ধরে ফেলা কঠিন। সাধারণ ডেলিভারির সঙ্গে এটার অ্যাকশন আর গতি বৈচিত্র্যের তারতম্য এতটাই কম যে ভারতের অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানরাও যেন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেলেন।

ওয়ানডের দুটি দ্বিশতকের মালিক রোহিত শর্মার কথাই ধরা যাক, যিনি পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেললে বড় ইনিংস খেলাকে অভ্যাসে পরিণত করেছেন। মুস্তাফিজের কাটারে বিভ্রান্ত হয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। টেকনিক্যালি এই ভারতের সবচেয়ে নিখুঁত ব্যাটসম্যান অজিঙ্কা রাহানে তল খুঁজে পাননি। থিতু হয়ে যাওয়া রায়না-জাদেজাও এই কাটারে বশ মানলেন। সবাই জানতেন, মুস্তাফিজের হাত থেকে এই কাটার এল বলে। কিন্তু প্রস্তুত থেকেও মিলল না বাঁচার উপায়।

আনকোরা তরুণের বাঁহাতের ঝলকে ভারত এতটাই দিশাহারা যে, দলের অধিপতি, ক্রিকেটবিশ্বে যার পরিচিতি ‘ক্যাপ্টেন কুল’ হিসেবে, তিনিও উদভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। এক যুগ ধরে ক্রিকেট আঙিনায় পদচারণায় পোড় খাওয়া মহেন্দ্র সিং ধোনি যখন তার সারা জীবনে অর্জিত ভাবমূর্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অভিষিক্ত এক তরুণকে দৃষ্টিকটু ভাবে ধাক্কা মেরে বসেন, তখন আনকোরা ওই তরুণই আসলে নতুন উচ্চতায় উঠে যান। ম্যাচ শেষে স্বয়ং ধোনির কণ্ঠেই সেই নতুন উচ্চতার ঘোষণা, “মুস্তাফিজের স্লোয়ারের জবাব জানা ছিল না আমাদের।”

বল হাতে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল মাঠের বাইরে যেন নিস্তরঙ্গ এক নদী। একটি রহস্যময় সুন্দর, আরেকটি সহজ সুন্দর।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার তেঁতুলিয়া গ্রামের কিশোর মুস্তাফিজ ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে ক্রিকেট অনুশীলনে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন ভোরে ঘুম ঘুম চোখে চেপে বসত বড় ভাইয়ের মোটরসাইকেলের পেছনে। তার আশ্চর্য ভ্রমণ আজ গিয়ে মিলেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। তাতে মিশে এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বপ্নও!