বিপিএলের কোচ-কাহন

বিপিএলের তারার মেলায় উজ্জ্বল ৬ দলের প্রধান কোচরাও। বিশ্ব ক্রিকেটের খ্যাতিমান কোচরা যেমন আছেন, তেমনি আছেন দেশের দুই জন নামী কোচও।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2015, 06:08 AM
Updated : 22 Nov 2015, 07:04 AM

শনিবার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের অনুশীলন শেষেও মিরপুর একাডেমি মাঠে রয়ে গেলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন, অপেক্ষার কারণ “ঢাকার প্র্যাকটিস দেখব, মিকি আর্থারের কোচিং দেখব। এত আলোচিত কোচ, তার কোচিংয়ের ধরন এবং সব কিছু দেখতে চাই কাছ থেকে।”

বাংলাদেশ অধিনায়কের কথাতেই ফুটে ওঠে, শুধু ক্রিকেটাররাই নয়, বিপিএলে আগ্রহ আছে কোচদেরও নিয়েও। এবার বিপিএলে ৬ দলের মধ্যে ৪টির কোচ বিদেশি, দুটি দলের কোচ দেশি।

মিকি আর্থার, ঢাকা ডায়নামাইটস

ক্রিকেটার-কোচ মিলিয়েও বলা যায় এবারের বিপিএলের অন্যতম বড় তারকা মিকি আর্থার। প্রোফাইল বেশ সমৃদ্ধ, একই সঙ্গে বিতর্কিতও। জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভালে, খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন ব্যাটসম্যান। ১১০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেললেও জাতীয় দলে খেলতে পারেননি কখনও।

২০০১ সালে ক্রিকেট ছাড়ার পর ২০০৩ সালে গ্রিকুয়াল্যান্ডকে দিয়ে শুরু কোচিং ক্যারিয়ারের। ২০০৫ সালে অনেকেই চমকে দিয়ে দায়িত্ব পেয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের। দায়িত্বের প্রথম দুই বছর সাফল্য-ব্যর্থতার মিশ্রণ থাকলেও পরের সময়টা ছিল সাফল্যে ভরা।

আর্থারের কোচিং ও গ্রায়েম স্মিথের নেতৃত্বে টেস্ট ইতিহাসে নিজেদের সেরা সময়টা কাটায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ৪৩ বছর পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়ের হাত ধরে আসে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবার সিরিজ জয়। টানা ৯টি টেস্ট সিরিজ অপরাজিত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়ানডেতেও উঠেছিল র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। কিন্তু ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ঝামেলায় দায়িত্ব ছেড়ে দেন ২০১০ সালের জানুয়ারিতে।

সে বছরই আর্থার দায়িত্ব নেন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার। ২০১১ সালের নভেম্বরে প্রথম বিদেশি কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের। তবে অস্ট্রেলিয়ার কোচ হিসেবে তার সময়টা ছিল বিতর্কময়। ভারত সফরে ‘হোমওয়ার্কগেট’ কেলেঙ্কারিতে চার ক্রিকেটারের নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় সমালোচিত হয়েছিলেন তুমুলভাবে। ২০১৩ সালের জুনে, অ্যাশেজের দুই সপ্তাহ আগে তাকে বরখাস্ত করে অস্ট্রেলিয়া। সে বছরই ক্রিকেট ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেন পার্থের ক্রাইস্ট চার্চ গ্রামার স্কুলের।

গত জুলাইয়ে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে আর্থারের কোচিংয়ে সেমি-ফাইনাল খেলেছে ক্রিস গেইলের জ্যামাইকা তালাওয়াহস। ৪৭ বছর বয়সী কোচের এবার নতুন চ্যালেঞ্জ ঢাকা ডায়নামাইটসকে নিয়ে।

গ্রাহাম ফোর্ড, বরিশাল বুলস

জেমি সিডন্সের বিদায়ের পর বাংলাদেশের সম্ভাব্য কোচ হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন গ্রাহাম ফোর্ড। জাতীয় দলের দায়িত্ব না পেলেও এবার বাংলাদেশে কোচিং করাতে এলেন বিশ্ব ক্রিকেটে দারুণ শ্রদ্ধেয় এই কোচ। দল সাজানোয় খানিকটা পিছিয়ে থাকা বরিশাল বুলস কোচ হিসেবে এনেছে নামী একজনকেই।

জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার পিটারমারিজবার্গে, ক্রিকেট ক্যারিয়ার বলার মত কিছু নয়। নাটাল ‘বি’ দলের হয়ে খেলেছেন কেবল সাতটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। অবশ্য তার প্রতিভা ছিল অন্য খেলাতেও। নাটাল প্রদেশে ছিলেন তিনি টেনিসের চ্যাম্পিয়ন; খেলেছেন নাটালের ফুটবল দলেও। আছে রাগবি ইউনিয়নে রেফারিংয়ের যোগ্যতা।

১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ ছুঁইছুঁই বয়সে নাটালের হয়েও কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। ১৯৯৮ সালে দায়িত্ব পান দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলের। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলে নিয়োগ পান বব উলমারের সহকারী হিসেবে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর উলমার সরে দাঁড়ালে ফোর্ড হন প্রধান কোচ। তার কোচিংয়ে ১১টি টেস্ট সিরিজের ৮টিই জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পিঠেপিঠি সিরিজে ব্যর্থতার পর ২০০২ সালের প্রথম দিনে তাকে বরখাস্ত করে দক্ষিণ আফ্রিকা।

এর পর নানা সময়ে ফোর্ড কোচিং করিয়েছেন ইংলিশ কাউন্টিতে কেন্ট ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ডলফিন্সকে। ২০০৭ সালে ভারত জাতীয় দলের কোচ হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও নেননি পারিবারিক কারণে। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে দেশের বাইরে অনেক আকর্ষণীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করেছেন বেশ ক’বার।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে ফোর্ড দায়িত্ব নেন শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের। ২ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পেয়েও বাড়াননি আবারও পারিবারিক কারণে। বর্তমানে তিনি ইংলিশ কাউন্টিতে সারের কোচ। এ ধরনের ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টিট লিগে কোচিং করাচ্ছেন এই প্রথম। বরিশাল দলের মতো তার নিজের জন্যও তাই চ্যালেঞ্জিং এবারের বিপিএল।

মারভান আতাপাত্তু, চিটাগং ভাইকিংস

কোচ হিসেবে শুরুতে রবিন সিংয়ের নাম জানিয়েছিল চিটাগং ভাইকিংস। ব্যক্তিগত কারণে তিনি না আসায় ঘোষণা করা হয় আকিব জাভেদের নাম। কিন্তু সংযুক্ত আর আমিরাত থেকে ছাড়পত্র না মেলায় আসতে পারেননি আকিবও। শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন ভাইকিংসের কোচ হয়ে এসেছেন শ্রীলঙ্কার মারভান আতাপাত্তু।

বিপিএল কোচদের মধ্যে এবার সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে আতাপাত্তুই সবচেয়ে বড় নাম। ৯০টি টেস্ট ও ২৬৮ ওয়ানডে খেলেছেন। ৬টি ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন টেস্টে। ছিলেন ব্যাটিং শুদ্ধতা ও নির্ভরতার প্রতীক। ১৮ টেস্ট ও ৬৩ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন শ্রীলঙ্কাকে।

তবে কোচিং ক্যারিয়ার এখনও ততটা সমৃদ্ধ নয় আতাপাত্তুর। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কায় ক্লাব কোচিং দিয়ে শুরু নতুন ক্যারিয়ারের। সে বছর দায়িত্ব নেন কানাডার ব্যাটিং কোচের, ২০১০ সালে সিঙ্গাপুরের প্রধান কোচ। ২০১১ সালে দায়িত্ব পান শ্রীলঙ্কার জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচের। ২০১৩ সালে পল ফারব্রেসকে শ্রীলঙ্কার প্রধান কোচের দায়িত্ব দেওয়ার সময় আতপাত্তুকে করা হয় সহকারী। পরের বছর ফারব্রেস আচমকাই দায়িত্ব ছাড়লে ভারপ্রাপ্ত প্রধান কোচ হন আতাপাত্তু। তার কোচিংয়ে ১৬ বছর পর ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পান প্রধান কোচের। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের কাছে টেস্ট সিরিজ হারার পর গুঞ্জন ওঠে তাকে সরিয়ে দেওয়ার। গত ৩ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন নিজে থেকেই।

বিপিএলে আসার আগে পাকিস্তানের একটি টিভিতে কাজ করছিলেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। হঠাৎ করেই বিপিএলের প্রস্তাব পেয়ে লুফে নিয়েছেন। ভাইকিংসকে শিরোপা এনে দিতে পারলে হয়ত কোচ আতাপাত্তুর ক্যারিয়ারও ডানা মেলবে নতুন করে।

শেন জার্গেনসেন, রংপুর রাইডার্স

বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিচিত নাম শেন জার্গেনসেন। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে তার স্মৃতি এখনও তরতাজা অনেকের মনেই।

অস্ট্রেলিয়ায় কুইন্সল্যান্ডের রেডক্লিফে জন্ম, ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ছিলেন পেসার। প্রতিভাবান হয়েও চোট-জর্জর ৮ বছরের ক্যারিয়ারে খেলতে পেরেছেন মাত্র ২৩টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। ৩২ বছর বয়সেই ক্রিকেট ছেড়ে নাম লেখান কোচিংয়ে। ২০০৮ সালে বোলিং কোচের দায়িত্ব পান নিউ জিল্যান্ড জাতীয় দলের।

২০১১ সালে জার্গেনসেন বোলিং কোচ হয়ে আসেন বাংলাদেশে। ২০১২ সালের অক্টোবরে রিচার্ড পাইবাস দায়িত্ব ছাড়লে ভারপ্রাপ্ত প্রধান কোচ করা হয় তাকে। তার কোচিংয়ে দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ওয়ানডে সিরিজে হারায় বাংলাদেশ। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারপ্রাপ্ত থেকে পুরো দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। তার কোচিংয়ে নিউ জিল্যান্ডকে দ্বিতীয় দফা হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ।

তবে টেস্টে বাংলাদেশের খুব বেশি উন্নতির ছাপ ছিল না, ওয়ানডেতেও পারফরম্যান্স ছিল না ধারাবাহিক। ২০১৪ এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের কাছে হারে বাংলাদেশ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হারে হংকংয়ের কাছে। দলের ওপর জার্গেনসেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও ছিল প্রশ্ন। বিসিবি তার বিকল্প খোঁজা শুরু করলে গত বছরের এপ্রিলে নিজে থেকেই ইস্তফা দেন পারিবারিক কারণ দেখিয়ে।

বাংলাদেশ থেকে ফিরে দায়িত্ব নেন ফিজির। সেখানে জাতীয় দল থেকে শুরু করে বয়সভিত্তিক দল এবং নারী দলের দায়িত্বও তার। তার কোচিংয়ে প্রথমবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে ফিজি।

এবার অবসর পেয়ে চলে এসেছেন বিপিএলে। চেনা আবহ, চেনা আঙিনায় নতুন দায়িত্ব। বিদেশি হলেও থাকবেন অনেকটা চেনা কোচের মতো। পেয়েছেন কাগজে-কলমে সেরা দলটিই। সবকিছুই পক্ষে জার্গেনসেনের। চ্যালেঞ্জ এবার দলকে প্রত্যাশিত সাফল্য এনে দেওয়ার।

সরওয়ার ইমরান, সিলেট সুপারস্টার্স

বাংলাদেশে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় কোচদের একজন সরওয়ার ইমরান। কোচিং করিয়েছেন বিকেএসপিতে। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে তিনিই ছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধন কোচের দায়িত্বে। বিভিন্ন সময়ে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে ছিলেন আরও কয়েকবার। ঘরোয়া ক্রিকেটে বিভিন্ন দলকে কোচিং করিয়েছেন সফলতার সঙ্গে।

ইমরানের হাত ধরে বাংলাদেশ পেয়েছেন অনেক ক্রিকেটার। এবার তার ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশি নামী কোচদের হারিয়ে বিপিএলে সিলটেকে শিরোপা এনে দিতে পারলে তার সাফল্য মুকুটে যোগ হবে উজ্জ্বল আরেকটি পালক।

মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স

বাংলাদেশের ক্রিকেটে মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের পরিচয় “ক্রিকেটারদের কোচ”। সাকিব-তামিম-মুমিনুল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের এখনকার জাতীয় দল ও দলের আশেপাশে থাকা অনেক ক্রিকেটারের তিনি সত্যিকারের ক্রিকেট গুরু। স্রেফ একজন কোচের চেয়ে তিনি বেশি কিছু। অনেকেরই তিনি অভিভাবক, ‘মেন্টর’ বা ‘গাইড’। যে কোনো টেকনিক্যাল বা মানসিক সমস্যায় বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটার সবার আগে দ্বারস্থ হন সালাউদ্দিনের।

সালাউদ্দিন দীর্ঘদিন কোচিং করিয়েছেন বিকেএসপিতে। বাংলাদেশ জাতীয় দলে ছিলেন ফিল্ডিং ও সহকারী কোচ। পরে সাফল্যের সঙ্গে কোচিং করিয়েছেন মালেয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের ক্রিকেটে কাজ করতে সম্প্রতি আবার ফিরেছেন দেশে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে আগামী অনেক দিন নানা ভূমিকাতেই হয়ত দেখা যাবে সালাউদ্দিনকে। তবে শুরুটা হচ্ছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স দিয়ে। কোচ সালাউদ্দিন ও অধিনায়ক মাশরাফির জুটি আর দলে দুজনের সম্পর্কের রসায়ন হতে পারে বিপিএলে কুমিল্লার সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি।