কুমার সাঙ্গাকারার প্রথম কোচ বাবা স্বর্ণকুমারা সাঙ্গাকারা। ক্যারিয়ার জুড়ে সাঙ্গাকারার সবচেয়ে কঠোর সমালোচকও ছিলেন বাবাই। সাঙ্গার টেকনিকে নানা খুঁত ধরতেন প্রায়ই। দ্বিশতক করার পরও বাবার বকুনি হজম করার কথা অনেকবার বলেছেন সাঙ্গাকারা নিজেই।
কীর্তিমান ছেলের অবসরের পর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘ লেখা লিখেছেন বাবা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হলো সেটির উল্লেখযোগ্য অংশ:
“একটি স্বীকারোক্তি দিয়ে শুরু করছি লেখা। ছেলেকে ব্যাট করতে দেখলে আমি সবসময়ই একটু অস্বস্তি-উৎকণ্ঠায় থাকতাম। জানি এটা বললে কেমন শোনাবে, কিন্তু আমি সত্যিই আগে থেকে বুঝতে পারতাম সে কখন আউট হতে যাচ্ছে। অনুমানশক্তি হতে পারে, কিন্তু কখনোই ভুল হয়নি আমার। এজন্য আমি আরও বেশি নার্ভাস থাকতাম। এমনকি অনেক সময় এক ওভার আগেই বুঝতে পারতাম সে আউট হতে যাচ্ছে।
আমি সবসময়ই ছিলাম ওর সবচেয়ে কঠোর সমালোচক। সে নিজেও এটা খুব ভালোভাবে জানত। টেকনিকের জন্য পুরো বিশ্ব ওকে শ্রদ্ধা করত। কিন্তু আমার মতে, কুমার কখনোই সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি। ওর যে স্কিল ছিল, আরও কত ভালো যে করতে পারত!
সবাই বলে ওর ব্যাটিং গড় গ্রায়েম পোলক, গ্যারি সোবার্সদের মতো। কিন্তু কুমার আরও ভালো করতে পারত। প্রায়ই বোলারদের ওকে আউট করতে হয় নি, সে নিজেই উইকেট উপহার দিয়ে এসেছে।
আমার কাছে ব্যাটিংয়ের শেষ কথা ডন ব্র্যাডম্যান। প্রতি তিন ইনিংসে একটি করে সেঞ্চুরি করেছে ডন। নিজেকে সত্যিকারের ব্যাটসম্যান ভাবলে, তেমন কিছুই করে দেখানো উচিত। আমাকে ভুল বুঝবেন না, কুমার ভালোই করেছে। কিন্তু সম্ভাবনার পুরোটা কি দেখাতে পেরেছে? আমার মনে হয় না পেরেছে।
কুমারের ক্রিকেট নিয়ে আমি কাজ করছি ওর একদম ছেলেবেলা থেকেই। ব্যাটিংয়ের হাত ওর সবসময়ই দারুণ ছিল। কিন্তু হাত ভালো থাকা আর টেকনিক পুরো আলাদা ব্যাপার। আমার মতে মাহেলা জয়াবর্ধনের টেকনিক বরং আরও ভালো ছিল, ডিফেন্স আরও আঁটসাঁট ছিল। কুমারের টেম্পারমেন্ট আর দৃঢ়তা ভালো ছিল বলে মাহেলার চেয়ে বেশি রান করেছে, গড় বেশি। কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করি, মাহেলা, মারভান আতাপাত্তু, অরবিন্দ ডি সিলভাদের নিজের খেলার ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল আরও বেশি।
কুমার স্পিনে পায়ের কাজ দেখিয়েছে সামান্যই। শুরুর দিকে স্পিন খুব স্বস্তিতে খেলতেও পারত না। পরে উন্নতি করেছে। তারপরও বলের কাছে যেতে অনেক সময় নিত। ডাউন দ্য উইকেটে ঠিকভাবে খেলতে না পারার কারণে আমার ভর্ৎসনা কম সইতে হয়নি ওকে। এমনকি শেষ দিনও মনে হয়েছে ওর পা খুব ভারী।
একজন ব্যাটসম্যানের প্রতি আমার বরাবরই দারুণ সমীহ ও শ্রদ্ধা, সুনীল গাভাস্কার। সে প্রথমে তার টেম্পারমেন্ট দিয়ে বোলারদের ক্লান্ত করে তুলত, এরপর স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছুটিয়ে তাদের কচুকাটা করত। বোলারদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টার সামনেও কখনো নতি স্বীকার করেনি। একজন সফল ব্যাটসম্যান অনেকটাই বক্সারের মত। লড়াই জিততে হলে দ্বাদশ রাউন্ড পর্যন্ত টিকে থাকতে হবে। কুমার বেড়ে ওঠার সময় ব্র্যাডম্যান-গাভাস্কারের খেলা ওকে আমি অনেক দেখিয়েছি, অনেক গল্প শুনিয়েছি।
কুমারকে আমি সহজাত প্রতিভা বলব না। তবে ওর ব্যাটিংয়ের হাত ছিল ভালো, দারুণ দক্ষ। অনেকেই হয়ত জানে না, টেনিসেও খুব ভালো ছিল কুমার। টেনিসই ছিল ওর প্রথম খেলা। অবশ্য ওর চেয়ে ভালো টেনিস খেলোয়াড় ছিল ওর বোন সারাঙ্গা। ১৫ বছর বয়সেই জাতীয় শিরোপা জিতেছিল সারাঙ্গা। পরে সে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিল, খুব ভালোও করছিল। কিন্তু কাঁধের চোট তার ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু কুমারের টেনিস প্রতিভা বেশি ছিল। একদিন সারাঙ্গা টেনিসে কুমারকে হারিয়ে দিল। ব্যস, তারপর থেকে আর কখনোই টেনিসকে গুরুত্ব দিয়ে নেয়নি কুমার। বোনের কাছে টেনিসে পরাজয়ের পরই ক্রিকেট ওর প্রথম পছন্দ হয়ে উঠলো। কুমার অবশ্য এখন এটা স্বীকার করতে চাইবে না!
ক্রিকেট নিয়ে আমার ও কুমারের প্রায়ই তর্ক হতো। শ্রীলঙ্কার রাজনীতি, দৈনন্দিন জীবন-যাপন নিয়ে অনেক আধুনিক ধ্যান-ধারণা ওর, আমার ওসবে অতটা আগ্রহ নেই। সব বিষয়েই ওর কোনো না কোনো মত আছে। যদিও আমার মতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমি ওকে তর্কে হারিয়ে দিয়েছি! আমার স্ত্রীর ধারণা, কুমার অনেকটা আমার মতোই। কিন্তু আমরা দুজনই নিজেদের মত নিয়ে প্রচণ্ড একরোখা।
কুমারের সব ইনিংস আমার প্রিয় নয়, অল্প কটিই ভালো লাগে। হোবার্টে হেরে যাওয়া ম্যাচে ওর ১৯২ রানের ইনিসংটি নিয়ে অনেক কথা হয়, হবে। এটা আমার প্রিয় ইনিংস। ভালোই ছিল ইনিংসটি। বিশ্বকাপে চার ম্যাচে চার সেঞ্চুরিও বেশ ভালো অর্জন।
আমার ছেলে ক্রিকেটার হলেও ক্রিকেট এখন আমার হৃদয়ের কাছে নেই। যদিও আমার ছেলে দারুণ সততায় মাথা উঁচু করে খেলেছে, কিন্তু এটা এখন আর ভদ্রলোকের খেলা নেই। আইপিএল এবং টি-টোয়েন্টি লিগগুলোয় যেসব দুর্নীতি হচ্ছে, খেলাটার ভাবমূর্তি প্রচণ্ড রকম ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কুমার আইপিএলে খেলেছে বলে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ওখানে সে নিজের মতো খেলতে পারেনি। ওর ব্যাটিংয়ের ধরন সব সংস্করণেই সফল হওয়ার মতো, কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে কখনোই সে গ্রেটের পর্যায়ে উঠতে পারেনি।
অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা আমাকে জানানোর সময় আমার দুঃখ, কষ্ট খুব হয়নি। দুজনই একমত হয়েছি যে সময় শেষ। অযথাই আঁকড়ে ধরে রেখে লাভ নেই।
জানি না, ভবিষ্যতের জন্য কুমার কি ভেবে রেখেছে। আমার মনে হয় না, এই পর্যায়ে আইন পেশাকে আর গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। আমি সেটা চাইও না। বয়স এখন ৩৭, এখন শুরু করলেও আইন পড়া শেষ করতে করতে আরও ৫ বছর লাগবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে করতে বয়স ৫০ হয়ে যাবে। তখন আর ওসব করে লাভ নেই।
আমি বরং ওকে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে দেখতে চাই। আশা করি, চ্যালেঞ্জটা সে নেবে। আমি চাই গলফটাকে সে গুরুত্ব দিয়ে নিক। ওর দক্ষ হাত ছোড়া ওই খেলায় খুব কাজে লাগবে। দই যুগ ধরে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেছে, লড়াকু মনোভাবটা কখনোই মরবে না। গলফ ওকে সেই সুযোগটা করে দেবে। একই সঙ্গে এই খেলায় চাইলে আরও ৩০ বছর থাকতে পারবে। বয়স এখানে কোনো ব্যাপার নয়।
আর আমি এই কথা দিতে পারি, ওকে গলফ খেলতে দেখলে আমি ক্রিকেটের অর্ধেক নার্ভাসও হব না!”