ব্যাংক ডাকাতিতে জঙ্গি সম্পৃক্ততার সন্দেহ

ডাকাতি নয়, হত্যা ও নাশকতা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টিই আশুলিয়ায় কমার্স ব্যাংকে হানা দেওয়ার উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এর সঙ্গে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও সন্দেহ তাদের।  

গাজীপুর প্রতিনিধিসাভার ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 April 2015, 04:03 PM
Updated : 23 April 2015, 11:23 AM

“আসলে ডাকাতি তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না, তাদের উদ্দেশ্য ছিল হত্যা করা, নাশকতা সৃষ্টি করা,” হামলার ধরন, অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার দেখে একথা বলেছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নূরুজ্জামান।

ডাকাতিতে জড়িত অভিযোগে মোট দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে একজন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত বলেও পুলিশের দাবি।

এই ডাকাতিতে জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, “ব্যাংক ডাকাতি-লুটতরাজ অনেক দেখেছি। কিন্তু এটা ভিন্ন। ডাকাতির উদ্দেশ্যে নয়, অন্য কিছু আছে।”

মঙ্গলবার দুপুরে কাঠগড়া বাজারে কমার্স ব্যাংকের শাখায় আগ্নেয়াস্ত্র, ধারাল অস্ত্র ও শক্তিশালী বোমা নিয়ে হানা দেয় ৮-১০ জন। তাদের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ও ধারাল অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন সাতজন। বোমার আঘাতে জখম হন কয়েকজন। 

ডাকাতির সময় এলাকাবাসী সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করে। তারা ধাওয়া করে ধরে ফেলে দুই ডাকাতকে, এদের একজন গণপিটুনিতে মারা যান। লুট হওয়া প্রায় ৭ লাখ টাকার প্রায় পুরোটাই উদ্ধার করে জনতা।

সহকর্মীদের নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর পুলিশ কর্মকর্তা নূরুজ্জামান বুধবার বিকালে সাভার থানায় সাংবাদিকদের বলেন, “টাকার লোভেই যে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা মনে করছি না আমরা।”

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় দেখা যায়, হামলাকারীরা প্রথমে ব্যাংকের এক নিরাপত্তা রক্ষীকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে জখম করেন, এরপর ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের টেবিলে বোমা রেখে ভল্টের চাবি চান। চাবি না দিলে ভেতরেই খুন করা হয় ব্যবস্থাপকসহ তিনজনকে।

এরপর পালানোর সময় বাইরে জড়ো হওয়া মানুষের উপর গুলি-বোমা হামলা চালায় হামলাকারীরা, তাতে চারজন নিহত হন।

যারা মারা গেছেন, তাদের সবাইকে কোপানো হয়েছিল জানিয়ে এই ডিআইজি বলেন, “বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা এভাবে ইতোপূর্বে ঘটেনি। ছিনতাই, লুটপাট ও ডাকাতি অনেক হলেও এভাবে মানুষ হত্যা করার নজির নেই।”

হত্যাকাণ্ডে যে ধরনের অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে, তাও বাংলাদেশে আগে দেখেননি এই পুলিশ কর্মকর্তা। 

র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের কর্মকর্তা মেজর খালিদের বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুল বলেন, বিদেশ থেকে বিস্ফোরক এনে ‘ইম্প্রোভাইজ ডিভাইস’ তৈরি করা হয়েছে।

“যে বোমা তারা ছুড়েছে, তা অত্যাধুনিক, এগুলো বাইরে থেকে কেনা সম্ভব নয়।”

ব্যাংকে হামলাকারীদের মধ্যে দুজন ধরা পড়লেও অন্যরা পালিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন স্থানে বোমা ফেলে গিয়েছিলেন। ওই বোমাগুলো বেশ শক্তিশালী বলে র‌্যাব আগেই জানিয়েছিল।

গণপিটুনির পর যাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল স্থানীয়রা, তার নাম সাইফুল। তার বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার হরেন্দ্রবাজার গ্রামে। তার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানতে পারেনি পুলিশ।

সাইফুলের দেওয়া তথ্যে বোরহান উদ্দিন নামে আরেকজনকে আটক করেছে পুলিশ। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের করা মামলায় দুজনকেই গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।     

ডিআইজি নূরুজ্জামান বলেন, “বোরহান শিবিরকর্মী। তার পুরো পরিবার শিবিরের সঙ্গে জড়িত। গাজীপুরে তার ভাড়া বাসা তল্লাশি করে বিপুল পরিমাণ জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়েছে।”

বোরহানের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার সংকরপাশা গ্রামে। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকায় স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকেন তিনি।

ডাকাতির ঘটনার পর মঙ্গলবার বিকালেই সন্তানকে নিয়ে বোরহানের স্ত্রী পালিয়ে গেছেন বলে পুলিশের দাবি। তার বাসা থেকে জঙ্গি সংশ্লিষ্ট বই উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। 

সাইফুল ও বোরহান জিজ্ঞাসাবাদে একেক সময় একেক রকম তথ্য দিচ্ছেন বলে জানান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেন, “এরা জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। নাশকতার উদ্দেশ্যেই তারা ব্যাংকের ভেতরে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।”

ডাকাতির পর মঙ্গলবার রাতে চন্দ্রার ভাতারিয়া এলাকায় বোরহানের বাসায় অভিযান চালিয়ে ওই ঘর তালা মেরে দেয় পুলিশ।

এছাড়া চন্দ্রা থেকে চারটি পিকআপ ও একটি কভার্ডভ্যান জব্দ করা হয়েছে, যেগুলো চন্দ্রার ত্রিমোড় এলাকার একটি ফিলিং স্টেশনে রেখে বিভিন্ন কারখানায় ভাড়ায় খাটাতেন বোরহান।

কালিয়াকৈর থানার ওসি ওমর ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাড়িগুলো জব্দ করে আশুলিয়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

ভাতারিয়া এলাকার ওই বাসা দেড়মাস আগে ভাড়া নেন বোরহান। এছাড়া পাশের একটি বাড়ির একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে তার গাড়ির এক চালককে স্ত্রীসহ থাকতে দিয়েছিলেন তিনি।

স্থানীয়দের উদ্ধৃত করে পুলিশ জানিয়েছে, ব্যাংক ডাকাতির পর বোরহানের স্ত্রী ও ওই চালকের স্ত্রী বাজারে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি।

এই ঘটনায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষের করা মামলায় সাতজনকে হত্যা এবং ব্যাংকের ভল্ট খুলে ছয় লাখ ৮৭ হাজার ১৯৩ টাকা লুটের অভিযোগ আনা হয়েছে। গ্রেপ্তার সাইফুল ও বোরহানের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৮/১০ জনকে আসামি করা হয়েছে ।

ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডাকাতরা ছয় লাখ ৮৭ হাজার ১৯৩ টাকা লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে ছয় লাখ সাত হাজার ২৫৫ টাকা ঘটনার পরপরই উদ্ধার করা হয়েছে।

অন্য মামলায় এক ডাকাত সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয় ২০০/৩০০ গ্রামবাসীকে আসামি করে মামলা করেছেন থানার এসআই জাকারিয়া হোসেন।