‘দেরিতে হলেও সত্যের জয় হয়েছে’

যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে দেরিতে হলেও সত্যের জয় ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সোহাগপুর বিধবাপল্লী পরিদর্শনে প্রথম যাওয়া দুই সাংবাদিক।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2015, 10:01 PM
Updated : 11 April 2015, 11:19 PM

শনিবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জামায়াতের এই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরা ডটকমের কাছে প্রতিক্রিয়া জানান সাংবাদিক জুলফিকার আলি মাণিক ও ফজলুর রহমান।

যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের জন্য ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত প্রতীকী গণ-আদালত। পরের বছর ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানের গঠিত হয় জাতীয় গণ-তদন্ত কমিশন।

এই কমিশনের একটি সচিবালয় তৈরি করে আট জন যুদ্ধাপরাধীর কর্মকাণ্ড নিয়ে দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহের কাজে অংশ নেন এই দুই সাংবাদিক।

সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে জুলফিকার বলেন, “ফজলু ও আমাকে কামারুজ্জামানের অপরাধের মাঠ পর‌্যায়ের অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কামারুজ্জামানের অপরাধের এলাকা জামালপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে আমরা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য গ্রহণ করি।”

ওই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তৈরি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন অনুমোদনের পর ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন।

জুলফিকার আলি বলেন, “আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্ম, বাংলাদেশের সঙ্গে বেড়ে উঠা প্রজন্ম। ৯৩-৯৪ সালে সেই সময়ের একজন তরুণ সাংবাদিক হিসাবে এ রকম একটা গুরু দায়িত্ব বা ঐতিহাসিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আনন্দ ও গর্বের ব্যাপার।”

জামায়াত সমর্থিত বিএনপি সরকারের সেই সময়ে নানা চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তখন জামায়াতের সহায়তায় বিএনপি ক্ষমতায়। তাই প্রশাসনও এই কাজের বিরুদ্ধে ছিল।

“আমরা যখন কথা বলতে গেলাম, তখন সাক্ষীরাও কথা বলতে কিছুটা ভীত ছিল বা তাদের অনেকে মনে করছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর এদের বিচার হয়নি। এতদিন পর বলে আর কি লাভ হবে?

“তাদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষায় একটা দুঃখ, অভিমান ও ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। অনেকের হয়তো মনে হতো, এতদিন পর বলে আবার বিপদে পড়বো কি-না।

“ওই সময়ে দায়িত্ব পেয়ে আমরা উৎসাহের সঙ্গেই কাজ করেছি। তবে আমাদের মনেও মাঝে মাঝে শঙ্কাটা দেখা দিতো, বিচার কি কোনদিন হবে?”

দুই যুগ আগে নিজের করা তদন্ত প্রতিবেদনকে ভিত্তি ধরে অনুষ্ঠিত বিচারের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আজ এতদিন পর সেই বিচারের চূড়ান্ত পরিণতি দেখে এমন একটা অসাধারণ অনুভূতি হচ্ছে, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

“ছোটবেলা থেকে আমরা একটা কথা শুনে আসছি, সব সময় সত্যের জয় হবেই। অনেক দেরিতে হলেও সেই জয় হয়েছে। একজনের ফাঁসি হয়েছে, সেটা আনন্দের নয়। সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটাই আনন্দ।”

সেই সময়ে সাহসী সহযোগিতার জন্য কয়েকজনের কথা স্মরণ করেন তিনি। এদের মধ্যে ছিলেন ট্রাক ড্রাইভার, যার ট্রাকে জোর করে মানুষ ধরে আনা নেওয়া করতো কামারুজ্জামান।

“লছমনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিনহাজ উদ্দিন মিনাল সেই সময়ে পায়ে হেঁটে আমাদের সঙ্গে কাজ করেছে। সেই সময় মোবাইল ফোনও ছিলো না, তাই দিন রাত কাজ করতে হয়েছে। আজ ওনার সঙ্গে কথা হয়েছে, কাঁদতে কাঁদতে তিনি কথা বলেছেন।”

সেই তদন্ত দলের অপর সদস্য সাংবাদিক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার‌্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ফজলুর রহমান বলেন, “কমিশনের পক্ষে আমি ও মাণিক সোহাগপুরে যাই। সেখানে ফুটবলার ফারুক ও বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যার অভিযোগের তথ্য প্রমাণ আমরা সংগ্রহ করি।

“আল বদর কমান্ডার কামারুজ্জামান মানুষকে ধরে ধরে সিঁড়ি নদীর কাছে এনে হত্যা করতো। আমরা ফারুকের মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। অপরাধ করলে যে শাস্তি পেতেই হবে, সব সভ্য দেশেই সেট হয়, সেটা আবার প্রমাণিত হয়েছে।

“বিচারের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রমাণিত হলো, এটা কোন প্রতিহিংসার বিচার না। ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মান সম্মত বিচার করে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।”