জামালপুরের আট ‘রাজাকারের’ প্রতিবেদন চূড়ান্ত

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এক পরিচালকসহ জামালপুরের আট ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2015, 12:26 PM
Updated : 24 March 2015, 12:26 PM

এরা হলেন- ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক শরীফ আহাম্মেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মো. আশরাফ হোসেন, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আব্দুল বারী, হারুন, মো. আবুল হাশেম, অ্যাডভোকেট মো. শামসুল হক ওরফে ‘বদর ভাই’ এবং এস এম ইউসুফ আলী।

তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১০টি ঘটনায় হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট ও গুমের অভিযোগ আনা হয়েছে।

মঙ্গলবার ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সেইফ হোমে সংবাদ সম্মেলনে এ তদন্ত প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়।

তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বলেন, “এদের মধ্যে দুজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হয়েছে। আমাদের স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।

“ইতোমধ্যে দুই-তিনজন দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে। বাকিরা এখনো দেশেই আছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।”

গত ৩ মার্চ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শামসুল হক এবং এস এম ইউসুফ আলীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার আগের দিন ওই দুজনসহ এই  আট ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল ট্রাইব্যুনাল।

আসামিদের গ্রেপ্তার নিয়ে তদন্ত সংস্থার ক্ষমতা বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হান্নান খান বলেন, “মাদকদ্রব্য, দুর্নীতির মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্তকালে আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেন। আমরা সরকারের কাছে বারবার এ ক্ষমতা চাওয়ার পরও তা আমাদের দেওয়া হয়নি।

“গ্রেপ্তারের ক্ষমতা চেয়ে লিখিতভাবে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।”

৯২ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনসহ ৫৯৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি মঙ্গলবারই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানান সমন্বয়ক হান্নান খান।

এ মামলায় জব্দ তালিকার ছয়জনসহ মোট ৪০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে বলে হান্নান জানিয়েছেন।

তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সদস্য সানাউল হক বলেন, “আগামীকাল ট্রাইব্যুনালের পাঁচ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমাদের অর্জন অনেক।

“১৭টি মামলায় ১৮ জনের বিরুদ্ধে বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ৬টি মামলায় ৯ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মামলা চলছে। এছাড়া আরো ২১ মামলায় ৩৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।”

তিনি বলেন, “এই পাঁচ বছরে আমরা প্রত্যেকটি কাজ যথাযথভাবে করার চেষ্টা করেছি। আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। আমাদের কাছে জাতির যে প্রত্যাশা ছিল তার কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছি। কাজ করতে করতে বিগত পাঁচ বছরে আমাদের যে দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে ভবিষ্যতে কাজের ক্ষেত্রে তা কাজে লাগবে।”

জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সানাউল হক বলেন, “আমরা জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন করেছি। তদন্তে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছি। সে প্রতিবেদন আমরা প্রসিকিউশনে জমাও দিয়েছি। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়নি।”

জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হলে তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন বলে জানান তিনি।

ট্রাইব্যুনালের পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে সাংবাদিকসহ তদন্ত সংস্থা ও ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট সবাইকে শুভেচ্ছা জানান হান্নান খান।

আটজনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ

অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের মে মাসে জামালপুর মহকুমায় শান্তি কমিটি, আলবদর বাহিনী গঠন, সাধনা ঔষধালয় দখল করে আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটির অফিস প্রতিষ্ঠা, সিংহজানী হাই স্কুলে আলবদরের প্রশিক্ষণ, জামালপুর পিটিআই হোস্টেল ও আশেকে মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেল দখল করে নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলা, আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যোগসাজশে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে আটক, নির্যাতন, হত্যা, লাশ গুম, লুটপাট ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই বুধবার রাত আনুমানিক ১০টার দিকে শহীদ ইয়াদ আলী মণ্ডলকে জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার মৈশা ভাদুরিয়ায় তার নিজের বাড়িতে গুলি করে হত্যা।

অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ১৯৬২ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত এমপিএ ও বিরোধী দলীয় ডেপুটি লিডার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও সংগঠক আব্দুল হামিদ মোক্তারকে মৈশা ভাদুরিয়ায় তার নিজের বাড়ি থেকে অপহরণ করে পিটিআই নির্যাতন ক্যাম্পে নিয়ে আটকে নির্যাতন। পরবর্তীতে তার লাশ গুম করা।

অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই রাত আনুমানিক ১০টার দিকে জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার মৈশা ভাদুরিয়ায় শামসুল আলমকে তার নিজের বাড়ি থেকে অপহরণ করে নির্যাতন।

অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার ধোপাদহের মো. সহিদুর রহমানকে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি) অপহরণের চেষ্টা এবং মৈশা ভাদুরিয়ায় মহির শেখ ওরফে মাধুকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতন।

অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই রাত আনুমানিক ১২টার দিকে তৎকালীন জামালপুর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান ওরফে সাদু চেয়ারম্যানকে তার শ্যালক আব্দুল হামিদ খানসহ সরিষাবাড়ী থানার বাউশী পঞ্চপীর থেকে অপহরণ করে জামালপুর পিটিআই নির্যাতন কেন্দ্রে আটক, নির্যাতন করে হত্যার উদ্দেশ্যে জামালপুর শ্মশানঘাটে নিয়ে আব্দুল হামিদ খানসহ মোট ১৭ জনকে গুলি করে পানিতে ফেলে দেওয়া। এদের মধ্যে  সাদু চেয়ারম্যানের হাতকড়া ঢিলা থাকায় সেটি খুলে তিনি প্রাণে রক্ষা পান।

অভিযোগ ৭: ১৯৭১ সালের ৯ জুলাই রাত আনুমানিক ১টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নুরুল আমিন মল্লিককে জামালপুরের দয়াময়ী পাড়ায় সিঅ্যান্ডবি রোডের (পুরাতন) তার বসতবাড়ি ‘মল্লিক ভিলা’ থেকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেওয়া।

অভিযোগ ৮: ১৯৭১ সালের অগাস্ট মাসে তৎকালীন আশেক মাহমুদ কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক শহিদুর রহমান খানকে অপহরণের চেষ্টা।

অভিযোগ ৯: ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আশেক মাহমুদ কলেজ হোস্টেলকে আলবদর ক্যাম্প করে সেখানে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন, হত্যা ও লাশ গুম।

অভিযোগ ১০: ১৯১৭ সালের মে মাস থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পিটিআই জামালপুর নির্যাতন কেন্দ্রে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে আটক, নির্যাতন করে হত্যার পর লাশ গুম।